বিনির্মাণঃ ধ্বংসাত্মক সমালোচনার বৈধতা

দেরিদা এই মুহুর্তে বাংলাদেশে খুব প্রাসঙ্গিক। দেশে সাহিত্যিক, চিন্তক বা টেক্সট মেইকারদের সাম্প্রতিক অনলাইন গোলাগুলি ও মারামারি দার্শনিক জাক দেরিদার ‘Deconstruction বা বিনির্মাণ’ নিয়ে নতুন করে আলোচনা করার সুযোগ করে দিয়েছে।



ভাষা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ একটি মাধ্যম। ভাষার মাধ্যমে আমরা সর্বশেষ চূড়ান্ত কোন ধারণা পেতে পারি না। কারণ ভাষা অস্থির, সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। আজ যা বোঝাচ্ছে, কাল তা নাও বোঝাতে পারে। আপনি যা বুঝছেন আমি তার উল্টোটা বুঝতে পারি। আমি এখন যা বুঝছি পরে আমার কাছে প্রয়োজন অনুযায়ী এর অর্থ পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ ভাষার বাজারে চিরস্থায়ী ‘বেদবাক্য’ বলে কিছু নেই । আপনি যে কোন টেক্সট বা লেখাকে সমালোচনা করতে পারবেন , নিজের মত করে ব্যাখ্যা বা সমালোচনা করতে পারবেন।


সমালোচনার অধিকার সকলের।


আপনি যে কোন লেখা বা টেক্সটকে গুরু-লঘু, হালকা- ভারী, সাদা-কালো , ভালো-মন্দ বলতে পারেন। কিন্তু বিনির্মাণে এইসব বাইনারি বিশেষণকে অস্বীকার করা হয়েছে। ভালো মানে আপনার কাছে ভালো, আমার কাছে মন্দ হতে পারে- এবং এটা বলার অধিকার আমার আছে । আসলে এই ধরনের সকল বাইনারিগুলো (ভালো-মন্দ, সঠিক-বেঠিক ইত্যাদি) পরিস্থিতি ও ব্যাখ্যাকারকদের ব্যাখ্যার উপর নির্ভরশীল । দেরিদা বলতে চেয়েছেন, যেকোন টেক্সটের ভিতরে অসংখ্য ধরনের স্ববিরোধিতা এবং বিপরীতমুখীতা থাকতে পা্রে। আপনি একটা কিছু বলতে চাচ্ছেন লেখার মধ্যে, কিন্তু রুপক ব্যবহার করে এড়িয়ে গেলেন, বা সরাসরি বলতে পারলেন না– পাঠক হিসেবে আমার অধিকার রয়েছে এটা আমার মত করে ব্যাখ্যা করার।


বিনির্মাণ কোন নির্দিষ্ট ফরমেটে আগায় না। সাধারণ যুক্তি, চিন্তা, ব্যাখ্যা, জনপ্রিয়ধারা ইত্যাদির বাইরে অবস্থান নেয়ার শৃঙ্খলাহীন বুনো স্বাধীনতার নাম বিনির্মাণবাদ। যদি কোনো সমালোচক রবীন্দ্র, নজরুল, রুমি, শেলি ইত্যাদি কবিগণকে মাইনর কবি মনে করে টেক্সট নির্মাণ করেন সেটা বিনির্মাণবাদের একটি অংশ। আপনি যদি এই পাগলাটে টেক্সটকে অ্যাটেনশন সিকিং দাবি করেন এবং নাকচ করে দেন সেটাও বিনির্মাণ। কোন দার্শনিক বা চিন্তক অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বিনির্মাণবাদী সমালোচনার মধ্যে তার চিন্তা বা দর্শনের জগতকে সীমাবদ্ধ করে রাখেন, সেটি করার স্বাধীনতা তার রয়েছে।



বিনির্মাণ অন্য একটি টেক্সটকে তদন্ত ও জেরা করার একটি উপায়– এবং মৌলিক উপায়ে নিজেকেও তদন্ত ও জেরা করতে পারে। বিনির্মাণ কোন টেক্সটের পূর্ণতা খুঁজে বেড়ায় না বরং অপূর্নতাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বিনির্মাণ পজিটিভ কিছু দেখাতে পারবেনা– দেখাবে অপূর্ণতা, অপরিহার্যতা কিংবা অপর্যাপ্ততা। কোন কিছু কমপ্লাই করার দায় তার মধ্যে নেই, যে কোন টেক্সটের আগের ব্যাখ্যাগুলোর সাথে নতুন বিনির্মিত ব্যাখ্যার মিল রাখার দায় নেই। বহুজনের দেয়া ধারণামূলক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা গ্ণতান্ত্রিভাবে ঐক্যমত পোষণ করা আইডিয়াকে ছিন্ন-ভিন্ন করে দিতে পারে। যেকোনো আইডিয়া বা টেক্সটকে সংশয়ের মধ্যে ফেলা যায়। বিনির্মাণবাদিতা প্রতিষ্ঠিতকে ধ্বংস করবে। বিনির্মাণ হলো নিরন্তর ঘটমান ধ্বংসের সমষ্টি। দেরিদার মতে, সংশয় দর্শনের জননী। কোন চিন্তাকে পিঞ্জরে আবদ্ধ করার কিছু নাই, কোন জ্ঞানকে সুপ্রিম মনে করার কিছু নেই। এখন আমরা যে জ্ঞান অর্জন করলাম, তা হচ্ছে পরবর্তী জ্ঞানের সূচনা বা মুখবন্ধ।


দেরিদার মতে যে কোন ফরমেটে যেকোন টেক্সটের পূর্বনির্ধারিত কোন কাঠামো, অর্থ, চিন্তা, বা দ্যোতনা বা কিছুই নেই । বিনির্মাণের মাধ্যমে, সমালোচনার মাধ্যমে এগুলোর মধ্যে একটি নতুন পথ খুঁজে পাওয়া যায়। সমালোচনা সাহিত্যের একটি নিয়মিত অংশ। বিনির্মাণবাদ সাহিত্যের অন্যান্য শাখার সাথে সমালোচনার কোন পার্থক্য করে না। সমালোচনার মাধ্যমেই পুরাতন ধ্বংস (Destruction) হয়, নতুন কিছু নির্মাণ হয় (Construction); এই এই দুইয়ে মিলে হয় De-construction, বাংলায় বলা হয় বিনির্মাণ।


বিনির্মাণের প্রাতিষ্ঠানিক কোন ফর্মুলা নেই। যে কোন টেক্সট থেকে প্রাপ্ত যুক্তিতর্কগুলোকে চূর্ণ করে দিতে পারে বিনির্মাণ। একজন বিনির্মাণবাদী সমালোচক সর্বদাই প্রাপ্ত তত্ব, তথ্য, যুক্তিকে পুনর্নবায়ন করতে পারেন। যে কোন চিন্তাকে বা চিন্তার কাঠামোকে সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক করে ফেললে, এই সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রুপকে পেরিয়ে নতুন চিন্তাকে প্রস্তাব করাই হচ্ছে বিনির্মাণ।


বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে, নিজের জানার পরিধিতে, দৃশ্যমান রূপকল্পে নিয়ত পরিবর্তন ঘটায় বিনির্মাণ। বিনির্মাণ একটি চেতনার নাম, বুদ্ধিবৃত্তিক নিয়মের রাজত্ব থেকে মুক্তির অপার সম্ভাবনা। পূর্ব-সূরীদের সঠিক মনে করে করা ভুলগুলো ভুল হিসেবে তুলে ধরতে পারে এটি। বিনির্মাণবাদী ভাষ্যকাররা প্রথমে প্রাপ্ত বা পঠিত ধারণাগুলোকে পর্যবেক্ষণ করবেন। তারপর, জিজ্ঞাসা ও পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত বা প্রচলিত ধারণাগুলোর অন্তঃসারশূন্যতাকে প্রকট করে তুলে ধরবেন। সমালোচনায় সত্য মিথ্যার দ্বিমেরুতা নেই, পর্যবেক্ষণ প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠিত টেক্সটের অন্তঃসারশূন্যতা আবিষ্কারই বিনির্মাণ।


জাক দেরিদা বিনির্মাণ বিষয়ক কোনো সংজ্ঞা বা তত্ত্বের মাধ্যমে এসব না বলে, কাজের মাধ্যমে বিনির্মাণের কার্যপরিধি তুলে ধরেছেন। ছোট্ট উদাহরণ হিসেবে দেখানো যায়, তার আগে পশ্চিমা দর্শনের সবচেয়ে পরিচিত আইডিয়া ছিল, মুখের কথার পরে এসেছে হাতের লেখা। কিন্তু দেরিদা বলেন, আগে লেখা, পরে এসেছে মুখে বলা। অর্থাৎ প্রথমে তিনি আগে-পরে এ ধরনের দুটি বাইনারি নিয়ে ও এগুলোর হায়ারার্কি ও গঠন নিয়ে চিন্তা করেছেন। তারপর প্রচলিত আইডিয়ার সাথে কনফ্লিক্ট করেছেন।


বিনির্মাণকে সকলেই সহজভাবে সমান ভাবে গ্রহণ করবে না। আমরা যারা শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে, তারা যেমন নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসবাদীতাকে সহ্য করতে পারি না, বিনির্মাণ বিরোধী পন্ডিতেরাও বিনির্মাণকে সেরকম সহ্য করতে পারে না। বিনির্মাণকে তারা নৈরাজ্যবাদী হিসেবে অভিহিত করেন। তত্ব হিসেবে এটি অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। বিনির্মাণকে সুস্পষ্ট সংজ্ঞার মধ্যে না ফেলে জাক দেরিদা তার তত্বকেও বিনির্মিত করার সুযোগ রেখেছেন।


এসব আসল কথায় আসি। ভলতেয়ার বলছেন, "I disapprove of what you say, but I will defend to the death your right to say it."। যুক্তিকে আক্রমণ ও ব্যক্তিকে আক্রমণ পুরো আলাদা ব্যাপার। যুক্তি বা টেক্সটকে আক্রমণ বিনির্মাণ, ব্যক্তি আক্রমণ ক্রিমিনাল অফেন্স।


লেটস এনজয় অনগোয়িং ‘অনলাইন গোলাগুলি ও মারামারি’।
---

নোটঃ তপোধীর ভট্টাচার্যের লেখা ভীষণ কঠিন ও দুর্বোধ্য। পড়তে গিয়ে দাত নড়বড়ে হয়ে গেছে। জনাব হোসেন ও আলমের সম্পাদিত বইটিতে অনেকগুলো লেখকের প্রবন্ধ রয়েছে। ধীরে ধীরে পড়লে আবছা একটা আইডিয়া আসতে পারে। প্রথম কমেন্টে বই দুটির ছবি আছে।


মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত

আধুনিক আমলাতন্ত্র: ওয়েবার থেকে ইভানস

চেপে রাখা অর্থণীতি: মুক্তবাজারের মিথ্যাবাজার

জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কথন

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

সজল রোশানের ' রিলিজিয়াস মাইণ্ডসেট' কেমন?

ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রচিন্তা: আলথুসেরের রাষ্ট্রপাঠ