চেপে রাখা অর্থণীতি: মুক্তবাজারের মিথ্যাবাজার


মুক্তবাজার অর্থনীতি রাষ্ট্রীয়  সকল রোগের মহৌষধ ।  উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিতরা  সকলেই  নিও-লিবারেল মুক্তবাজার অর্থনীতির চর্চা করে এতদূর পর্যন্ত এসেছে।  অতীতেও তাদের বাজার আমদানি-রপ্তানির জন্য উম্মুক্ত রেখেছিল,  সর্বনিম্ন  আন্তর্জাতিক শুল্ক প্রয়োগ করা হয়েছিল,  যাতে  দেশগুলো একে অপরের সাথে প্রয়োজনমতো সেবা, প্রযুক্তি বা পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারে।  এতে ভোক্তারা সর্বনিম্ন মূল্যে  সরকারি বাধা ছাড়াই দেশি-বিদেশি পণ্য ও সেবা গ্রহণ করতে পারবে।   ব্যয় সাশ্রয় হবে,   সাশ্রয়কৃত  অর্থ বিনিয়োগ করে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে। রাষ্ট্রায়াত্তকরণ,  বিদেশি পণ্যের আমদানি, বিদেশি বিনিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা,  দেশিপণ্যের উপর ভর্তুকি প্রদান , রক্ষণশীল বাণিজ্যনীতি মুক্তবাজার হলো নব্য-উদারবাদ অর্থনীতির অন্তরায়।  দেরিতে হলেও ১৯৮০ এর পর থেকে পৃথিবীর সব দেশ, বিশেষ করে  অনুন্নত দেশগুলো বুঝতে পেরেছে তাদেরকেও বড় ভাইদের মতো মুক্তবাজার অর্থনীতির সর্বোচ্চ চর্চা করতে হবে,  নতুবা তারা কোনদিনই উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছাতে পারবে না”।
---------–মুক্তবাজার অর্থনীতির  ধারক,  বাহক ও  পৃষ্ঠপোষক পশ্চিমাদেশ ও প্রতিষ্ঠানগুলো, এবং  তাদের  মতাদর্শে তৈরিকৃত  স্থানীয় অর্থনৈতিক চেলা-চামুন্ডারা এসব কথাই শিখিয়ে-পড়িয়ে-গিলিয়ে  আসছিল বিগত    চার-পাঁচ দশক থেকে।  প্রকৃত সত্য হলো, বর্তমানে উন্নত  দেশগুলো যখন উন্নয়নশীল থেকে উন্নত দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন  ঠিক উল্টোটা করেছে। আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানীসহ  সকল উন্নত দেশগুলোর  অতীত হলো ভর্তুকি, সুরক্ষা, রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ও সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার অর্থনৈতিক ইতিহাস। 

ইউএসএ-এর কথা আলাপ করা যাক। আলেকজান্ডার হ্যামিলটন আমেরিকার জাতির  পিতাদের  একজন,  ছিলেন প্রথম অর্থমন্ত্রী [১৯৮৯--৯৫]।  হ্যামিলটন আমেরিকার আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার স্থপতি । নিয়োগের দুবছর পর কংগ্রেসে দেয়া  রিপোর্টে বলেছিলেন,   সদ্যোজাত  বা শিশু  শিল্পকারখানাগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে  সহযোগিতার মাধ্যমে   নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো আগ পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে হবে।   সরকারি খরচে পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার সুবিধা বাড়াতে হবে, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায়   ব্যাংক তৈরি করতে হবে, সরকারি বন্ড মার্কেট দাঁড় করাতে হব।   তবে তার  পলিসির  কেন্দ্রবিন্দু ছিল নিজস্ব নতুন শিল্পকে প্রোটেকশন দিয়ে ম্যাচিউরড করে বড় শিল্প হিসেবে গড়ে তোলা। হ্যামিলটন আজকে যদি কোন উন্নয়নশীল দেশের অর্থমন্ত্রী থাকতেন,  আইএমএফ ও  ওয়ার্ল্ড  ব্যাংক তার সমালোচনা করে কচুকাটা করে দিত।   

হ্যামিলটনকে নিয়োগ দেয়া প্রেসিডেন্ট  জর্জ ওয়াশিংটন সাহেব প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল বক্তৃতায় বলেছিলেন, উন্নত মানের ব্রিটিশ কাপড়ের পরিবর্তে কানেক্টিকাটে বানানো  নিজেদের কাপড় পড়তে হবে। সিভিল ওয়ারের সময় [১৮৬১-৬৫] প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বিদেশি পণ্যের উপর শুল্ক সর্বোচ্চ হারে  বাড়িয়েছিলেন।  এই উচ্চ ট্যারিফের পরবর্তী ফলাফল হিসেবে   ব্রিটেনসহ ইউরোপ থেকে যখন চাপ আসছিল, তখনকার প্রেসিডেন্ট গ্র‍্যান্ট ইউলিসিস [১৮৬৯-৭৭] বলেন, ২০০বছর পর যখন আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা ব্রিটেনের মত শক্তিশালী হবে তখন তারাও শুল্ক বন্ধ করে মুক্তবাজার ঘোষণা করবে।  

ইউরোপের তুলনায় আমেরিকায়  শ্রমমূল্য চার গুণ বেশি হওয়ার যুক্তিতে  পরবর্তীতে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন শুল্ক বৃদ্ধি করে স্থানীয় শিল্পের নিরাপত্তা দিয়েছেন।


১৮৩৬ সালে অধিক বিদেশী ( মাত্র ৩০%)  বিনিয়োগ থাকার অপরাধে সেমি- পাব্লিক ব্যাংক অফ ইউএসএ বন্ধ করে দেয় ৭ম প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু  জ্যাক্সন। বর্তমানে  কোন দেশ যদি আমেরিকার নাগরিকেদের ৩০% বিনিয়োগ থাকার অপরাধে কোন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয় তাহলে একটা খারাবি হয়ে যাবে।  অর্থনীতি বিষয়ে আমেরিকান   ফাউন্ডিং ফাদারদের  পুরনো কথা শুনলে  মনে হয়,  বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, সাইফুর রহমান  বা আবুল মাল  মুহিত  কথা বলছেন। 

আমেরিকার আরেকজন জাতির পিতা থমাস জেফারসন মনে করতেন  বাতাসের যেমন কোন মালিক নাই, ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি বলে কিছু থাকার দরকার নাই।  এখন আবার উলটা কথা শোনা লাগে। বর্তমানে  পশ্চিমা ও পশ্চিমাপন্থী ইকোনোমিস্টরা বাজারের  সবকিছু খুলে দিতে মহাউদগ্রীব হলেও, প্যাটার্নের প্রোটেকশনের জন্য পারলে শহীদ হয়ে যায়।  প্যাটেন্ট রাইট নিয়ে নিও-লিবারেলদের এ অবস্থান ডাবল-স্ট্যান্ডার্ড।


১৮৮০ এর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য  শুল্কের হার ছিল কমবেশি ৫০% । বেশিরভাগ লোক ভোট দিতে পারত না, ইলেকশন জালিয়াতি খুব স্বাভাবিক ছিল তখন। বিদেশীদের বিনিয়োগ করার ভালো কোন সুযোগই দেয়া হতো না,  তাদের ব্যাংকের পরিচালক পদে বসানো হতো না,  কোন ধরনের প্রতিযোগিতামূলক বাজার ছিল না,  সিন্ডিকেট ছিল অহরহ,  মনোপলি করার সুযোগ ছিল উন্মুক্ত।  দেশীদের প্যাটেন্ট রাইট নিয়ে কিছুটা শক্ত পলিসি থাকলেও বিদেশীদের প্যাটেন্ট রাইটের কোন পাত্তাই দেয়া হতো না। ইচ্ছে মতো চুরি করত।

আজকে আমেরিকা থেকে যখন মুক্ত বাজার অর্থনীতির আওয়াজ উঠে,  তখন  মনে করিয়ে দেয়া দরকার, তাদের জাতির পিতা ও পুর্বপুরুষরা কেমন প্রোটেকশনিস্ট , কন্সারভেটিভ বাজার ব্যবস্থা  চালিয়ে গেছেন।

 দ্বিতীয় সারির একটি কৃষিভিত্তিক দেশ থেকে আমেরিকা আজকের এই উন্নত বিশ্বশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতির মাধ্যমে নয় বরং শক্তিশালী বাণিজ্যিক সুরক্ষাবাদ  চর্চা করে। তবে শুধুমাত্র আমেরিকা নয়,   ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক থেকে শুরু করে পৃথিবীর বেশিরভাগ উন্নত দেশগুলো শুরুর দিকে এ চর্চা চালিয়েছে।  সুরক্ষাবাদ ছাড়া তাদের আর কোন শর্তের প্রয়োজন হয়নি।

 অনেকে মনে করে ব্রিটেন মুক্ত বাণিজ্য অর্থনীতির চালু করেছে।   শিশুশিল্প বা সদ্যোজাত শিল্পের প্রোটেকশন তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে   দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও লর্ড অফ ট্রেজারি রবার্ট ওয়ালপোল [ ১৭২১-১৭৪২ ] অর্থনীতির  ভিত্তি নির্মাণ   করেন। এ সময়ে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ছিল উল ইন্ডাস্ট্রি।  বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড ইত্যাদি দেশ থেকে  এ শিল্পকে সুরক্ষা দেয়ার জন্য  উচ্চশুল্ক আরোপ করা  হয়,  সাবসিডিসহ সকল সাহায্য  দেয়া হয়। 

রাষ্ট্রের খরচে শক্তিশালী নেভিগেশন ও ডিফেন্স ব্রিটিশিদের  উন্নয়নের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। ১৮৬০ এর দিকে প্রথম মুক্ত বাণিজ্য শুরু করে ব্রিটেন।  ততদিনে তারা সারা দুনিয়ার বিভিন্ন কলোনি শাসন-শোষণ, দমন ও বৈষম্যমূলক নীতিমালা,  নিজস্ব শিল্পের সুরক্ষা  বা অন্যান্য পলিসির মাধ্যমে উন্নত দেশ হিসেবে  দাঁড়িয়ে গিয়েছে।  এসব পলিসির মাধমে ভারতবর্ষের বস্ত্র, জাহাজনির্মাণ শিল্পথেকে শুরু করে  নানাবিধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কিভাবে ধ্বংস ও বি-শিল্পায়ন করে, সেটার একটা বিস্তারিত বর্ণনা পাবেন শশী থারুরের ‘ইনগ্লোরিয়াস এম্পায়ার’ বইতে। 

 ১৭২০ থেকে ১৮৫০ বৃটেন,  ১৮৩০ থেকে ১৯৪০ আমেরিকা পৃথিবীতে  সবচেয়ে বাণিজ্যিক সুরক্ষা পলিসি প্রয়োগ করেছে, আর এ সময়েই তারা অর্থনৈতিক সুপার-পাওয়ার হিসেবে গড়ে উঠে। 

প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত দেশগুলোর উন্নয়নের  সিঁড়ি  ছিল ভর্তুকি ও স্থানীয় সদ্যোজাত শিল্পের  সুরক্ষানীতি। গরীব দেশের ভর্তুকি নিয়ে,  রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা নিয়ে নানা ছবক দিলেও নিজেরা বিপুল  সরকারী টাকা খরচ করে রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট খাতে, এগুলোর সমান সুফল  পায় প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলোও। 
কিছু দেশ যেমন জাপান, কোরিয়া, ফিনল্যান্ড  বিদেশি বিনিয়োগের উপর  কড়া  নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল।  অবিশ্বাস্য হলেও  সত্য যে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান ইত্যাদি দেশের উন্নয়নের ভিত্তি রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত বড় বড় শিল্প-কারখানাগুলো।  মুক্ত বাজারের  এ  রমরমা যুগেও  সিঙ্গাপুরের ২০%  উৎপাদন হয় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা থেকে,  যেখানে সারা বিশ্বের গড়  হচ্ছে ১০%।  

 বেশিরভাগ উন্নত দেশগুলো শুরুতে ইন্টারন্যাশনাল  ইন্টালেকচুয়াল প্রপার্টির প্যাটেন্ট নিয়ে  তেমন মাথাব্যথা ছিল না। অভ্যন্তরীণ প্যাটেন্ট রাইটের চর্চা ছিল মোটামুটি।  বিশ শতকের   গোড়ার দিকে নেদারল্যান্ড,  সুইজারল্যান্ড  পেটেন্ট আইনের স্বীকৃতি দেয় । হংকং কয়দিন আগেও  আন্তর্জাতিক প্যাটেন্ট পলিসিগুলো পাত্তা দিত না। 

 অর্থনৈতিক ইতিহাসের সত্যিগুলো  এমন ভাবে চেপে রাখা হয়েছে,  এবং বর্তমানে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যে, বেশিরভাগ মানুষ সত্য ইতিহাসগুলোকে সত্য ভাবতে সাহস পায়না।  আমরা প্রবাদে পড়েছি,  গাছে উঠিয়ে মই কেড়ে নেয়া।  অর্থনীতির ইতিহাসের ক্ষেত্রে প্রবাদটা এমন-  নিজে গাছে উঠে,  মই সরিয়ে নেওয়া,  যাতে পরে আর কেউ গাছে না উঠতে পারে।
উন্নত নিও-লিবারেলরা অনুন্নত দেশের উচ্চ-শুল্ক, উচ্চ-ভর্তুকি, স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা,  সরকারি ব্যবস্থাপনায় শিল্প-কারখানা পরিচালনা ইত্যাদি পলিসিকে সারাদিন গালিগালাজ করে,  বাজে-দুর্বল হিসেবে বিশেষণ দেয়,  কিন্তু অতীতে তারা এগুলো ব্যবহার করেই গরীব থেকে উন্নত হয়েছে।   এখন  যে পলিসিগুলোকে খারাপ পলিসি বলছে,  এগুলো হয়তোবা তাদের জন্য বা একটি স্থিতিশীল উন্নত অর্থনীতির জন্য খারাপ– কিন্তু একটি অনুন্নত,  স্বল্পোন্নত,  উন্নয়নশীল দেশের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। 

অনুন্নত  দেশগুলোর উচিত নতুন নতুন শিল্পকে যেকোন ভাবে সুরক্ষা দিয়ে  বড় করে গড়ে তোলা।  

গরীব অর্থনীতির দেশগুলোতে যোগাযোগ ব্যবস্থা খারাপ থাকে,  তথ্যপ্রবাহ অবাধ থাকে না,  বাজারের আকার অনেক ছোট হয়ে থাকে,  বড় পার্টিগুলো সহজেই মনোপলি করতে পারে। সুতরাং, নিও-লিবারেলিস্টদের বয়ানমত মুক্তবাজার যেভাবে কাজ  করা উচিত এখানে সেভাবে কাজ করে না। পাশাপাশি,  প্রাইভেট ফার্মগুলো তেমন শক্তিশালী হয় না,  ফলে তারা উচ্চ ঝুঁকির বড় মাপের বিনিয়োগ করার  সামর্থ্য রাখেনা। এমতাবস্থায়, সরকারের উচিত জায়গা বুঝে বড় আকারে বিনিয়োগ করে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। 

 দুঃখের কথা হলো,  উন্নত দেশগুলো উন্মুক্ত বাজার সুবিধা নিয়ে  জোর করে গরিব দেশগুলোর জামাকাপড় খুলে নেয়, ঠ্যালা দিয়ে দরজা খুলে ফেলে, মার্কেট দখল নেয়। দ্বিপাক্ষিক ঋণ,  আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ঋণ ও বাণিজ্যিক সংস্থাগুলোর শর্তগুলো হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে গরীব দেশের বাজার খুলে দেয়ার জন্য। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক বুদ্ধিবৃত্তিক  চর্চাগুলোতে, একাডেমিয়াগুলোতে মুক্তবাজার নিয়ে নানারকম রঙিন স্বপ্নের গল্প শোনানো হয়,  অতীত ইতিহাস মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়।  এসব হার্ড ও সফট পাওয়ার ব্যবহার করে উন্নত দেশগুলো যখন  অনুন্নত ছিল  তখন যে পলিসিগুলো ব্যবহার করেনি,  উন্নত হওয়ার পর সেই পলিসি গুলো দরিদ্র দেশগুলোকে  গিলতে বাধ্য করছে। 

তাদের   অন্তর্নিহিত বক্তব্য,  ‘আমরা যা করেছি তা তোমাদের করার দরকার নাই, যা বলি তাই করবা’। 
মুক্ত বাজার নামের সবচেয়ে বড় ধোঁকাবাজি হচ্ছে   দুনিয়ার সব কিছু যাতায়াত করতে পারবে বাজারের দরজা ভেঙ্গে, দেয়াল  ভেদ করে কোন বাধা ছাড়াই;  কিন্তু যাদের জন্য এ বাজার, এ অর্থনৈতিক আলোচনা, সেই মুক্তবাজারের মুক্ত মানুষগুলো মুক্ত ভাবে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে পারে না। এটা চিন্তা করাও বেআইনী করেছে উন্নত নিও-লিবারেলরা।

মুক্তবাজার অর্থনীতির বর্তমান সৈনিকরা বলার চেষ্টা করে,  রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ  ও সুরক্ষাবাদ গত শতাব্দীর মাঝামাঝি  পর্যন্ত কাজ করলেও এখনকার বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে কাজ করবে না। এসব করতে গিয়ে গত শতাব্দীর ষাট সত্তরের দশকে  অনেক অনুন্নত দেশ  বিপদে পড়েছে, কাঙ্খিত উন্নয়নের ধারায় পৌঁছাতে পারেনি।  

  তবে বাস্তবতা বলছে,  সাব-সাহারান আফ্রিকা ও পৃথিবীর অন্যান্য দরিদ্র দেশগুলোতে ষাট ও সত্তরের দশকে  প্রতিবছর জিডিপির গ্রোথ হয়েছে প্রায় ১.৩% হারে, ল্যাটিন আমেরিকার হয়েছে ৩.১% হারে।  আর ১৯৮০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত  নিও-লিবারেল বাজার অর্থনীতির সবচেয়ে রমরমা অবস্থায়,  বাজার উমুক্ত করে সাব সাহারান- আফ্রিকার দেশ জিডিপি গ্রোথ শুন্যের নিচে এবং ল্যাটিনোদের গ্রোথ ১.১% এ নেমে আসে। এসব পলিসি তাদের সম্ভাবনাময় শিশুশিল্পগুলোকে ধ্বংস করে দিয়েছে,  বি-শিল্পায়ন হয়েছে দ্রুতগতিতে । প্রিম্যাচুরড লিবারালাইজেশন অনুন্নত এ দেশগুলোকে পঙ্গু করে দিয়েছে। 

 ২০০০ সালের গোড়ার দিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়ন গ্রাফ উপরের দিকে উঠলেও তা মূলত হয়েছে চীন-ভারতের অস্বাভাবিক ঊর্ধগতির উন্নয়নের জন্য।   মনে রাখতে হবে,  দেশদুটো বাজার একটু উদার করলেও প্রকৃত অর্থে নিউ-লিবারেল পলিসি গ্রহণ করেনি।  

হাতি বিপদে পড়লে গাছে উঠে। অর্থনৈতিকভাবে একটু চাপে পড়ে পৃথিবীর নানা উন্নত  দেশে ট্যারিফ ওয়ারের ঘোষণা আসছে। মুক্তবাজারের তীর্থস্থানে ভোটের অন্যতম ইশতেহার হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সাথে শুল্কযুদ্ধ। অর্থাৎ প্রয়োজন হলেই উন্নত দেশগুলোই তাদের গসপেল বা প্রিচিং থেকে সরে আসতে দুই সেকেন্ড সময় নেবে না। তবে গরীবদের সাথে যতদিন সুবিধা নিয়ে সুবিধামত বাজার দখল করা যায় ততদিন মুক্তবাজারী চলতে থাকুক এটাই তারা চায়। 


laissez-faire বা অবাধনীতি বা অর্থণীতিকে নিজের।মতো কাজ করতে দেয়া একটি মিথ। একটা মিথ্যে ভরা গালগল্প। অনুন্নতদেশগুলো এডাম স্মিথের চাহিদা-যোগানের অদৃশ্য হাতের উপর তাদের অর্থনৈতিক ও বাজার ব্যবস্থা ছেড়ে দেয়া আত্বঘাতী। অনুন্নত দেশগুলোর উচিত সংরক্ষণবাদী ও হস্তক্ষেপবাদী নীতির ইতিহাসকে নিজেরা স্বীকৃতি দিয়ে একই ধরণের কৌশল নিজেরা বাস্তবায়ন করা। গরীবদের মনে রাখা উচিত এখনো তারা গরীব। তাদের মনে রাখা উচিত উন্নত নিও-লিবারেলদের দেয়া মুক্তবাজার প্রেসক্রিপশন অর্থনৈতিক স্বার্বভৌমত্ব কেড়ে নেয়া ও অধিপত্য চাপিয়ে দেয়ার নয়া কৌশল, ঋণ-ফাদে জর্জরিত করে অনন্তকাল পায়ের নিচে রাখার চালাকি। উন্নতরা নিজেরা গাছে উঠে যে মই ভেঙ্গে  দিতে চাইছে, সেই মই ধ্বংস করার  আগেই সেটা ব্যবহার করে অনুন্নতদের গাছে উঠার জোর চেষ্ঠা করা উচিত। উন্নতরা যা বলে তা না করে তারা যা করেছে সেটাই করা উচিত।


মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত

আধুনিক আমলাতন্ত্র: ওয়েবার থেকে ইভানস

জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কথন

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

বিনির্মাণঃ ধ্বংসাত্মক সমালোচনার বৈধতা

সজল রোশানের ' রিলিজিয়াস মাইণ্ডসেট' কেমন?

ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রচিন্তা: আলথুসেরের রাষ্ট্রপাঠ