ব্যাঙ কালচার, গ্যাং কালচার
আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ০২: ৪৫
ঘটনার কাল বেশি দিন আগের নয়। বড়জোর বছর পনেরো-বিশেক। ব্যাপারটা ছোট মফস্বল শহর কিংবা গ্রামের পরিচিত দৃশ্য। ছেলেরা খেলত দল বেঁধে। দলে ভালো ছেলেরাও খেলত, খেলত দুষ্ট ছেলেরাও। শান্ত পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে ছেলেরা ঢিল ছুড়ে দিত। পানির পৃষ্ঠ টানের প্রভাবে ঢিল ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে দুই-তিন গোত্তা খেত। কার ঢিল কয়টা লাফ দেয়, তা নিয়ে মহা কমপিটিশন। তবে অতি দুষ্টদের এত নিরামিষ খেলায় সব সময় পোষাত না। তারা হালকা কিংবা ভারী বর্ষা-বাদলের দিনে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করা ব্যাঙদের লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়ত। এতে দুই-চারটা ব্যাঙ চিৎপটাং হতো। এ দেখে পাশের বাড়ির মুরব্বি হাঁক দিতেন, ‘এই, দুষ্টামি করিস না। দুষ্টামি করলে ঠ্যাং ভেঙে দেব।’ তারা স্কুলের র্যাপিড রিডিং বা দ্রুত পঠনে পড়ত ‘দুষ্ট ছেলে ও কথা বলা ব্যাঙ’। গল্প পড়ে অনুশোচনায় ভুগত দুষ্ট বালকেরা। আহা! আমাদের জন্য যা ক্রীড়া, তাদের জন্য জীবনের প্রশ্ন।
এলাকার মুরব্বির তিরস্কারে কিংবা স্কুলের র্যাপিড রিডারের প্রভাবে বালকেরা দু-চারবার এমন করার পর এ খেলায় আনন্দ হারিয়ে ফেলত। দলে সরদার বালকের প্ররোচনায় দিনে দিনে ফুটবল-কাবাডির দল গড়ে তুলত। তারা একটু বড় হলে এলাকায় পাঠাগার, স্কুলে নাটক, কালচার ইত্যাদির চর্চা করত।
সেই অযোধ্যা কিছু কিছু আছে হয়তো, কিন্তু রামেরা বিলুপ্তপ্রায়। গ্রামের পুকুরের সেই শান্ত টলটলে জল বাষ্প হয়েছে। বৃষ্টি ঝরে কত খাল-বিল-নদী পেরিয়ে বঙ্গোপসাগরের মাঝামাঝি চলে গেছে। দেশে ডিশ অ্যানটেনা বিস্তৃত হয়েছে, বেড়েছে একক পরিবার। জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাতের ঘর ছুঁয়েছে। পাশের ফ্ল্যাটের মুরব্বির সঙ্গে তেমন পরিচয় নেই। বাবা-মায়ের ব্যস্ততা বেড়েছে। তাঁরা ছেলেমেয়েদের ‘কোয়ালিটি’ সময় দেবেন মনে করে ‘কোয়ানটিটি’ সময়ও দিতে পারেন না। তাঁরা হাতে নগদ কোয়ানটিটি টাকা তুলে দেন, বাইক দেন, সন্তানদের যা লাগে সব দেন। এদের ব্যাঙ খেলার সুযোগ, সময়, মানসিকতা কিছুই নেই। তারা ফুটবল, কাবাডি খেলা, পাঠাগার, স্কুলে নাটক কালচারের দলের পরিবর্তে গড়ে তোলে ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজ’ ইত্যাদি নামের গ্যাং গ্যাং খেলার দল।
এরা ‘পার্টি’ করে, জোরে হর্ন বাজায়। এরা স্বাভাবিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে না। প্রচণ্ড গতিতে বাইক চালায়, রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। পরে আস্তে আস্তে নেশা, চুরি, ছিনতাই, খুনসহ যা যা সামনে আসে ও মজা লাগে, তার সবই করে। এদের গ্যাং বড় হয়। দলনেতা হয়। তারা এলাকা দখল করে। ব্যাঙের দিকে ঢিল না ছুড়ে বন্ধুদের দিকে গুলি ছোড়ে। তাদের র্যাপিড রিডিং আছে কি না, জানা যায় না; থাকলেও রিডার আছে কি না, তা নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ থেকে যায়। আদর-তিরস্কার কোনোটাই করার কেউ নেই। তাদের মুরব্বিরা লাইন মুরব্বি। মুরব্বিরা তাদের হাতে বন্দুক-চাকু তুলে দেন বলে শোনা যায়। তাদের দিয়ে মাদক দখলের ব্যবসাও করানো হয়। বিনিময়ে তারা ‘ডিসকো বয়েজ’দের বাবা-মায়ের আদরে আগলে রাখে। বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয় নিজেদের স্বার্থে। দিন শেষে তাদের মাথাব্যথার কারণ হলো, মাদক, দখল ব্যবসা, স্ট্যাটাস, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ। যে গ্যাং বেশি বখে যায়, গ্যাং সমাজে সে গ্যাংকে বেশি সম্মান দেওয়া হয়।
অপরাধবিজ্ঞানী আলবার্ট কোহেন এ ধরনের কিশোর অপরাধের স্বরূপ নির্ণয় করেছেন। তাঁর ভাষ্যমতে, একটি খাপছাড়া সমাজে বাড়ন্ত শিশু-কিশোরেরা নিজেদের সব সময় মূলধারার সঙ্গে নিজেদের একাত্ম করতে পারে না। চলমান সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শ বুঝতে পারে না। তারা যে সমাজে বেড়ে উঠছে, সে সমাজ যেহেতু তাকে সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দিকনির্দেশনা দিতে অক্ষম, তাই তারা নিজেদের মতো সাব-কালচার তৈরি করে। তারা সমমনা অন্য কিশোরদের সঙ্গে নিয়ে গ্যাং তৈরি করে। উন্নত দেশে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, সুবিধাবঞ্চিত ও সংখ্যালঘুদের মধ্যে এ সমস্যা দেখা যায়। উচ্চবিত্তরা সাধারণত মাঝেমধ্যে ‘হিপ্পি’ভাব ধরে নেশাটেশা করে আবার ঠিক হয়ে যায়। তবে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে উচ্চবিত্তের গ্যাং কালচারের ক্ষত দেখা যায়। অন্য আরেকজন সমাজবিজ্ঞানী ফিল কোহেন গ্যাং সাব-কালচারকে পুঁজিবাদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের জনক রবার্ট কিং মেরটন বলেছেন, একই সমাজে বসবাসকারীদের মধ্যে লক্ষ্য ও অর্জনের পদ্ধতির মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষিত হলে এ সমস্যা তৈরি হয়।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে গ্যাং কালচারের উত্থান ও এর সমাধানের উপায় সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো মতামত দিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানী ট্রাভিস হিরশি। তঁার মতে, সামাজিক বন্ধন যখন দুর্বল হয়ে যায় অথবা ভেঙে যায়, তখন এ সমস্যা প্রকট হয়। অর্থাৎ সমস্যার সমাধান আমাদের সমাজব্যবস্থার মধ্যেই নিহিত। পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা, মূলধারার সাংস্কৃতিক চর্চা, নিয়মিত খেলাধুলার সুযোগ, সামাজিক ঐকতান ইত্যাদি পারে গ্যাং কালচারের অনুপ্রবেশ বাধা দিয়ে আমাদের কিশোর-তরুণদের মাথা বিগড়ে যাওয়া রোধ করতে।
প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে এই গ্যাং কালচার মাঝেমধ্যেই আমাদের সমাজকে ‘ব্যাঙ’ (প্রচণ্ড আঘাত) করবে, তখন আমাদের মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হবে। এটা আমাদের সমাজের শক্তিশালী সম্ভাবনাময় অংশের মেরুদণ্ড বাঁকা করে দেবে। পরবর্তীকালে তারা আর সোজা হয়েই দাঁড়াতে পারবে না। তাই সমস্যা সমাধানে নজর দেওয়ার সময় এখনই। পাছে বেশি দেরি হয়ে গেলে এই শূন্যতা আর সাধারণ আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো যাবে না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন