মানুষের নিজের স্বার্থেই উচিত প্রকৃতিকে নষ্ট না করা
সমুদ্রজয় ও অভিযানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে ইউরোপের আধুনিক সভ্যতা। সমুদ্রের নিয়ন্ত্রণ আরবদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ১৫০০-১৮০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় ৮৭% ভূমি কব্জা করে উপনিবেশ স্থাপন করে ইউরোপীয়রা।
পৃথিবীর আদি আইনগুলো রচিত হয়েছে জমির দখল নিয়ে-- কার ভাগে কতটুকু ভূমি। এরপর আইন আসে কার সমুদ্র কতটুকু সে ধারণা হতে। মাটি, পানি হতে আস্তে আস্তে আইন উঠে আসে ক্রিমিনাল অফেন্স ও অন্যান্য বিষয়ে।
আগে মানুষের প্রধান সম্পত্তিও ছিল ভূমি। শুরুতে যারা আইনপ্রণয়নের সাথে জড়িত ছিল তারা ছিল প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক। পরে সম্পত্তির ধারণা দাঁড়ায় ভূমি ও শ্রমের সংমিশ্রণ হিসেবে। উপনিবেশিক শক্তিরগুলো সকল ভূমির অপদখল ও আদিবাসীদের হত্যা জায়েজ করার জন্য এগিয়ে এলো নানা বুদ্ধিজীবী বা তাত্বিকেরা। জন লক বললেন, যে জমিতে কৃষিকাজ করে না তার জমিতে অধিকার নেই। সে জমিতে জন্তু-জানোয়ারের মত থাকে। ইউরোপিয়ান আইনের ভাষায় এসব জমিকে বলা হত টেরা নুলিয়াস বা পতিত জমি। শুরুতে মানুষের অর্থনীতি ভূমি কেন্দ্রিক হলেও পরে আস্তে ডাল পালা ছড়িয়ে স্টক মার্কেট বা ভার্চুয়াল মুদ্রা পর্যন্ত পৌছে যায়। আগের মত খাওয়া-পড়ার জন্য আমাদের জমির পাশে বসত গড়তে হয় না। দূর হতেই কাজ করে একাধারে অর্থনীতি চাঙ্গা করি আবার সময়মত খাবার পাই।
এই অর্থনীতির উন্নতি আমাদের খাবার ও চিকিতসার সুব্যবস্থা করে দিয়েছে। ধাই ধাই করে জনসংখ্যা বেড়ে গেল। ১৮৫০ এর ১০০ কোটি, ১৯৫০ এ হয় ২৫০কোটি, ২০০০ এ এসে জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৬০০ কোটি। অনুমান করা হচ্ছে ২০৫০ এ দাঁড়াবে ১০০০ কোটি। এই বাড়তি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত আছে ফুয়েল বা এনার্জি। মাটির নিচ থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি তুলে নিয়ে এসে এত মানুষের নানাবিধ চাহিদা পূরণ করতে গিয়েই যতঝামেলা। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড সহ অন্যান্য নানাবিধ গ্রিন হাউজ গ্যাস বাড়ছে, ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। এই ২০ বিশ বছর আগেই বিষয়টি গুরুত্বের সাথে না নিলেও এ পর্যায়ে এটি একটি জ্বলন্ত ইস্যু।
আজ যারা উন্নত তারা বিপুল জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করেই উন্নত। তারা নির্বিচারে পরিবেশের ক্ষতি করেছে এবং করছে। আবার উদীয়মান দেশগুলোর জন্য পরিবেশের দোহাই দিয়ে উন্নয়ন ব্যহত করা অনেক কঠিন।
এত মানুষের বাড়তি খাদ্যের জন্য অতিরিক্ত সার-কীটনাশক মাটি-পানির গুণাবলী ও অনেক প্রজাতির প্রাণির জীবন চক্র নষ্ট করে দিয়েছে। মোটকথায় আইন, অর্থনীতি, কৃষি বা পরিবেশ দূষণ বিশ্বায়নজাত একেকটি ইস্যু।
আজকের এত কিছু হতে সময় লেগেছে বিলিয়ন বছর। ২.৫ বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর বুকে অক্সিজেন সঞ্চারের মাধ্যমে বর্তমান ধাচের জীবসমূহের সূত্রপাত। এরপর ধাপে ধাপে মানুষের এ রমরমা অবস্থা। ১৯৫০ সাল থেকে মানুষ আচ করতে পারে বাতাসে হিট ট্র্যাপ হচ্ছে, তাপমাত্রা বাড়ছে। কয়েকশ মিলিয়ন বছরে তৈরি জীবাশ্ম জ্বালানিগুলো আমরা দু/তিন শতাব্দীতেই নিঃশেষ করে দিচ্ছি। তাপমাত্রা ও কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যাওয়ায় জীব বৈচিত্রে সংকট দেখা দিচ্ছে। সমুদ্রে এসিডিটি বেড়ে যাচ্ছে, অক্সিজেন উতপাদনকারী সায়ানোব্যাকটেরিয়া মরে যাবে, ক্যালসিয়াম শেলের প্রানীগুলো ডিজলভড হয়ে যাবে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও পুজিবাদ মানুষকে ভাবতে শিখাল মানুষ আর প্রকৃতি আলাদা স্বত্বা। নিজেদের একটু ভালোর জন্য পৃথিবীর প্রাকৃতিক যে সিস্টেম আছে, যা সমস্ত প্রাণিকুলকে বাচিয়ে রাখে তা ধ্বংস করছি। উন্নয়নের নামে আমরা ধ্বংস ডেকে আনছি।
পৃথিবীর অতিমারীর ইতিহাস খুব বেশি পুরোনো নয়, মাত্র দশএগারো হাজার বছরের পুরোনো, একসাথে মিলেমিশে কৃষিকাজ ও পশুপালন শুরুর পর। ডোমিস্টিকশন প্রসেসে নানাবিধ ভাইরাসের পোষকদেহ হিসেবে শেষ আশ্রয় মানুষ। বেশি অর্থনৈতিক অগ্রগতি বেশি প্রোটিন চাহিদা তৈরি করে। এ চাহিদা মিটানোর জন্য নানা অদ্ভুত বন্য প্রাণিও আস্তে আস্তে পশুপালনের আওতায় ও খাবারের মেনুতে চলে এসেছে, সাথে করে নিয়ে এসেছে মরনঘাতী ভাইরাস। ভাইরাসগুলো দ্রুত মিউটেশন হয়, আমাদের মধ্যে বাসা বাধে। উপনিবেশ ও বিশ্বায়নের কোল হতে গড়ে উঠা যোগাযোগ ব্যাবস্থার উন্নতি এ ভাইরাস ছড়িয়ে দেয় অল্পসময়ে। ভ্যাক্সিনেশন এর চাপ পড়ে, বাণিজ্য হয়।
মানুষের এক ত্রুটি সে নিজেকে অন্য প্রানীদের চেয়ে আলাদা ভাবার জন্য নিজেকেই প্রকৃতির বাইরের কিছু মনে করে। কিন্তু আসলে মানুষ প্রকৃতির অংশ মাত্র। মানুষের নিজের স্বার্থেই উচিত প্রকৃতিকে নষ্ট না করা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন