কি শিখব সান জুর আর্ট অফ ওয়ার থেকে?

 পড়েছি এবং পাতায় পাতায় বিস্মিত হয়েছি। সান জুর আর্ট অফ ওয়ার বিস্ময়ের খনি। যেহেতু আমি যুদ্ধ বা আর্মির কেউ নই, তাই বোধহয় বইটি  আমার  কাছে   ধরা দিয়েছে লাইফ ম্যানেজমেন্ট, ব্যবসা,  লিডারশিপ, রাজনীতি,  ডিপ্লোমেসি-বুরোক্রেসির অনবদ্য  গাইডলাইন হিসেবে। ভুল হতে পারে, সান জুকে ম্যাকিয়াভেলি ও চানক্যের চেয়ে বেশি  আধুনিক ও  প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে।

সান জুর লক্ষ্য ছিল যুদ্ধ জয়। আপনি তার উপদেশগুলো নিজের প্রিয় বিষয়ের সাথে মিলিয়ে বুঝে নিতে পারেন। লিডারশিপ নিয়ে আমার আগ্রহ আছে।  আমি এর সাথে মিলিয়েছি। ২৫০০ বছর আগে এত অগ্রসর চিন্তা অবাক করেছে। প্রথমেই ভাল লেগেছে, ডেলিগেশন অফ পাওয়ারের একটা আদর্শ উদাহরণ হিসেবে। কাউকে কোন দায়িত্ব দিতে হলে কাকে দায়িত্ব দেবেন সেটা রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত, কিন্তু কিভাবে কাজটি উদ্ধার হবে সেটার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকে পূর্নাঙ্গ ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। অযথাই নন কাউকে সুপারভাইজর / এডভাইজর হিসেবে দিয়ে কন্ট্রোল করাটা প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যহত করে। যুদ্ধক্ষেত্রে জেনারেল মনোনয়ন দেয়া রাজা বা সোভারিনের ক্ষমতা , এর বাইরে যুদ্ধ পরিচালনা হবে জেনারেলের চৌকষ গুনাবলী দ্বারা।  রাজসিংহাসন থেকে বসে বসে ফরমান জারি করে যুদ্ধ পরিচালনার মত শয়তানি আর নাই।

প্রকৃত নেতা নিজের সম্মান , ইগো , লাভক্ষতির জন্য লড়াই করে না , সে যুদ্ধ করে জয়ের জন্য, রাজার জন্য। অধীনস্তরা তার সন্তানের মত, তাদের খাওয়াদাওয়া আশ্রয়সহ সকল সুবিধা নিশ্চিত করে নিজে সুবিধা নেবে। অধীনস্তরা তার জন্য অন্ধভাবে মৃত্যুর মুখে ঝাপিয়ে পড়ে জয় এনে দেবে। একজন প্রকৃত নেতা একদিকে  দয়ার সাগর আবার শৃঙ্খলার প্রশ্নে  নির্মম। অধীনস্তদের কমান্ড না শোনা, কনফিউজড হয়ে যাওয়া, দল-উপদলে ভাগ হওয়া, অপ্রয়োজনীয় জায়গায় শক্তি খরচ করে দুর্বল হয়ে যাওয়া , মনোবল দুর্বল থাকা –সবকিছুর জন্য এককভাবে দায়ী তাদের নেতা।

নেতার কাছে জয়ের অনেক পথ রয়েছে, সবচেয়ে নিশ্চিত পথ হচ্ছে নিজের লোকজনকে জানিয়ে দেয়া , ফেরার আর পথ নেই, হয় বাঁচো না হয় মরো। শত্রুকে সবসময় চারদিকে থেকে আক্রমন না করে একটা পালানোর পথ রাখা উচিৎ। এতে তারা সামান্য বিপদেই পালিয়ে যাবে, অন্যদিকে বাচার কোন রাস্তা না থাকলে কঠিন যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে যুদ্ধ জয় কঠিন করে দেবে।পলায়নপর শত্রুকে আক্রমন অনুচিত।  আবার নিজের বাড়ির পাশেই  যুদ্ধ শুরু করা উচিৎ না, এতে সৈন্যদের মধ্যে হোমসিকনেস কাজ করবে আর পলায়নপর মনোবৃত্তি পাবে। প্রতিপক্ষকে তার সুবিধাজনক গ্রাউন্ডে লড়াই করার সুযোগ দেয়া যাবেনা, নানা উপায়ে রাগান্বিত ও দ্বীধান্বিত করতে হবে, তারপর আচমকা অপ্রত্যাশিত দিকে হতে আক্রমণ করে জয় ছিনিয়ে নিতে হবে। ঢালু জায়গায় নিজের সৈন্য উপরের দিকে রাখতে হবে, নিচে থেকে যুদ্ধ করে জয় আনা যায় না। ক্যাম্পিং এর সময় সূর্যালোক নিশ্চিত করতে হবে সৈন্যদল শক্তিশালী ও নিরোগ থাকবে।

যুদ্ধ করে শত রাজ্য জয় কোন বীরত্ব নয়, বিনাযুদ্ধে একটি জয় প্রকৃত বীরত্বের প্রদর্শন। অক্ষত ও অজেয় থাকা নির্ভর করে প্রতিরক্ষা শক্তির উপর, জয় পেতে লাগে শক্তিশালী আক্রমন। সবচেয়ে দুর্বল জায়গা খুঁজে শক্তিশালী আক্রমন সেখানেই করতে হবে। সাধারন শক্তি বা সৈন্য কাজে লাগে প্রতিপক্ষকে ব্যস্ত রাখতে, অসাধারণ চৌকষ সৈন্যদল জয় এনে দেয়। সৈন্যের সংখ্যা জয় আনে না, নেতার নেতৃত্ব , জ্ঞান ও বিচক্ষনতা জয় ঘরে তুলে আনে।

ডিভাইড এন্ড রুল আমরা মনে করি ব্রিটিশদের আবিষ্কার। বৃটিশদের বহু আগেই যুদ্ধ জয়ে শত্রু শিবিরকে নানাভাবে বিচ্ছিন্ন করতে বলেছেন সান জু। সক্রেটিস বলেছেন , নিজেকে জানো। সমসাময়িক সময়ে সান জু বলেছেন , নিজেকে জানো, তোমার শত্রুকেও জানো। প্রতিপক্ষকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পড়ে ফেল, তাদেরকে সঠিকভাবে  না জেনে যুদ্ধে  জড়ানো যাবে না। শুধু বিপদে পরলে প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সাহায্য চেয়ে লাভ নাও হতে পারে, বরং সুসময়েই তাদের নানা উপঢৌকন ও বিনিময়ের মাধ্যমে সুসম্পর্ক জোরদার করা উচিৎ। অন্যথা, বিপদ বুঝতে পারলে তারাই আক্রমন করে দখল করে নিতে পারে। কোনভাবেই তাদের ভীতিপ্রদর্শন করা যাবে না। শত্রু আক্রমন আসন্ন মনে না হলেও সর্বদাই প্রস্তুত থাকাটা জরুরি, প্রস্তুত থাকা  সৈন্যদলের  শৃংখলা বজায় রাখে, হটাৎ সৈন্য ও উপকরণ সংগ্রহ করে যুদ্ধ করার ঝুকি থাকে না।

আধুনিক গোয়েন্দাগিরি কত প্রকার ধারণা নেই। সান জু বলেছেন পাঁচ প্রকার। শত্রুদেশ বা এলাকা  থেকে গোয়েন্দা বের করে তাকে নেইটিভ গোয়েন্দা হিসেবে কাজে লাগাতে বলেছেন। শত্রুশিবির হতে কোন সৈনিক, অফিসার বা লোকবলকে ভাল উপঢৌকন সুযোগ সুবিধার লোভ দেখিয়ে ইন্সাইড এজেন্ট হিসেবে কাজে লাগানো যায়। শত্রুর গোয়েন্দাকে চিনে তাকে ভালো লোভ দেখিয়ে ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজে লাগাতে বলেছেন। নিজের ফলস এজেন্ট তৈরি করে ভুলভাল তথ্য সহকারে শত্রুশিবিরে ইচ্ছে করে  ধরা পড়ে বিপক্ষ শিবিরকে বোকা বানায় এক্সপেন্ডেবলস এজেন্ট। যে কোন পরিস্থিতিতে চৌকষ যে গোয়েন্দারা যে কোন অবস্থায় শত্রু শিবিরের হাল তথ্য আনতে পারবে তারা হচ্ছে লিভিং এজেন্টস। সঠিক গোয়েন্দা তথ্য ছাড়া ভালো আর্মি গড়ে তোলা অসম্ভব।

যাইহোক, যুদ্ধ, যুদ্ধক্ষেত্র, শত্রুপক্ষ,  সৈন্য, জেনারেল, রাজাদের নিয়ে আমাদের কাজ নেই। বরং এ ধরণের শব্দগুলো মেটাফোর বা রুপক হিসেবে নিয়ে বইটি পড়তে হয়, তাহলে প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাবেন। আসলে  আপনাকে জোর করে রুপক মাথায় রাখতে হবে না, শুধু কোনরকম পড়লেই বর্তমান বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তার সাথে মিলে যাবে। 

একটা উদাহরণ দেই, “ যখন শত্রুপক্ষ রাতের বেলা বিশ্রামের সময় হৈচৈ, চিল্লাচিল্লি করে শক্তি প্রদর্শন করে , বুঝে নিতে হবে তারা প্রচন্ড ভয়ের মধ্যে আছে, ভয় থেকে দূরে থাকার জন্য এমন আচরণ করছে”।


মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত

আধুনিক আমলাতন্ত্র: ওয়েবার থেকে ইভানস

চেপে রাখা অর্থণীতি: মুক্তবাজারের মিথ্যাবাজার

জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কথন

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

বিনির্মাণঃ ধ্বংসাত্মক সমালোচনার বৈধতা

সজল রোশানের ' রিলিজিয়াস মাইণ্ডসেট' কেমন?

ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রচিন্তা: আলথুসেরের রাষ্ট্রপাঠ