মানুষের সুখ-দুঃখ নিয়ে তিনটি ব্যাখ্যা

 মানুষের সুখ-দুঃখ নিয়ে  তিনটি ব্যাখ্যা আমার ভাল লাগে।

১. বুদ্ধের দর্শনঃ যখন মানুষ কষ্টে আছে বলে মনে করে এবং তা দূর করার জন্য নানারকম শারিরীক ও মানসিক যাতনার মধ্যে দিয়ে যায়, আরো  কষ্ট করে--যাতে তার দুঃখ দূরীভুত হয়, কিন্তু আসলে এটা  তাকে আরো অসুখী করে। আবার যখন কোন মানুষ নিজেকে সুখী মনে করে এবং তা চিরস্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য নানারকম মানসিক ও শারীরিক কষ্ট করে, এটা তাকে আরো দুঃখের মধ্যে ফেলে দেয়। অর্থাৎ আপনার সুখ অর্জন বা দুঃখ দূর করার অতি উপায় না খূঁজে বেড়ানোই আপনাকে সুখী রাখতে পারে। অবস্থার পরিবর্তনের আকাঙখা কিংবা বর্তমানকে সজোড়ে আকড়ে ধরে রাখার প্রচেষ্ঠাই আপনার সুখ কেড়ে নেবে। ঠিক কাছাকাছি ধরণের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় দুঃখবাদের দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ারের কাছে।  তার মতে, রিপিটিভ প্লেজারকেই সুখ বলে। দুনিয়াতে দুঃখের চেয়ে সুখ কম, সুখ ক্ষণস্থায়ী।  আপনার সুখী হওয়ার আকাংখা অন্যের দুঃখের দামে কেনা। অর্বাচীন লোকদের বদভ্যাস হচ্ছে সুখ শিকার করে বেড়ানো। নিজের মধ্যে সুখ খুজে পাওয়া কঠিন, অন্য কোথাও পাওয়া অসম্ভব।

২. সায়েন্সঃ সুখ-দুঃখের  জন্য দায়ী হরমোনের হ্রাস-বৃদ্ধি ( এন্ডোরফিন, সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন, ডোপামিন) পেলে মানুষ সুখ বা  দুঃখ অনুভব করে। এটা খুবই আপেক্ষিক। ধরুন আপনি রিক্সা চালান,  আপনার একদিনের ইনকাম ৫০০ টাকা  হঠাৎ  বেড়ে গেলে আপনার সুখী হরমোনগুলো আগের চেয়ে ৫/৬ একক বেড়ে গেল, আবার এলন মাস্কের টেসলার শেয়ার একদিনে কয়েক মিলিয়ন ডলার  বাড়ায় তার সুখী হরমোনের  পরিমান বাড়ল ৩/৪ একক, ঐ মুহুর্তে আপনার সুখানুভূতি এলন মাস্কের চেয়ে বেশি। আবার মিঃ মাস্কের শেয়ার দরপতন হলে তার হ্যাপি হরমোন হ্রাস  পাবে,  তখন আপনি তার চেয়ে বেশি সুখ অনুভব করবেন। খেয়াল করে দেখুন,  হরমোন বৃদ্ধি পেয়ে আকাশে উঠে বসে থাকে না, আস্তে আস্তে আবার নরমাল লেভেলে চলে আসে। অর্থাৎ,  আপনার এ অনুভূতিগুলো মারাত্বক ক্ষণস্থায়ী।  বলা যায়,  নরমাল সময়কে আপনি কিভাবে ব্যবহার করেন, কি ভাবেন, কি করেন এগুলোর উপর আপনার সুখানুভুতি নির্ভর করবে।

৩. হার্ভাড স্টাডিঃ সুখ নিয়ে আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাখ্যাটি এসেছে হার্ভাড ইউনিভার্সিটির টানা  প্রায় ৭৫ বছর ধরে চলা একটি গবেষণা ফলাফল থেকে। অনেক লার্জ স্যাম্পল নিয়ে ১৯৩৮ সালে শুরু করা  এ গবেষণার ফলাফল এসেছে ২০১৬ সালের দিকে। ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সুখ- দুঃখের ৫০-৬০% নির্ভর করে আপনার জিনের উপর। এখানে আমার -আপনার কিছুই করার নেই। বাকি ৪০-৫০% এর উপর আপনার কাজ করার আছে। গবেষণার সর্বশেষ প্রজেক্ট ডিরেক্টর ডঃ ওয়ালডিংগারের ভাষ্যমতে,  বিরাট স্যাম্পলের হেলথ, সাকসেস, আয় ইনকাম থেকে শুরু করে সবকিছু বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মানু্ষের সুখের মূল উপাদান তার সম্পর্কগুলো। পরিবার, প্রিয়জন, আত্বীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব কিংবা সোশাল সার্কেলের সাথে আপনার বন্ডেজ যত ভাল হবে আপনি তত সুখী। আপনার ভাল-মন্দ সময়গুলো শেয়ার করার, মন খুলে কথা বলার মত শক্তিশালী সম্পর্কগুলো আপনাকে অন্যের চেয়ে আপেক্ষিকভাবে সুখী করবে। তাই আমাদের উচিত সবার আগে আমাদের সম্পর্কগুলোর দিকে নজর দেয়া,  ভাঙাচোরা সম্পর্কগুলোকে জোড়া লাগানো, যাপিত সম্পর্কগুলোকে আরো শক্তিশালী করা।

খেয়াল করে দেখুন,  এতক্ষন যেসব বিষয়ে আলাপ হলো,  সেখানে  বেশ কিছু পরিচিত জিনিস একেবারেই অনুপস্থিত। মানি, ফেইম,  পাওয়ার, বিউটির সাথে সুখের ডিরেক্ট কোন সম্পর্ক নেই। আদিকালের গুহামানবদের চেয়ে  সিলিকন ভ্যালির মহামানবদের বেশি সুখী হওয়ার কোন উপাদান পাওয়া যাচ্ছে না। আবার,  মানি, ফেইম,  পাওয়ার, বিউটি না থাকলেই আপনি সুখী হবেন সেটাও বলা যাবে না।

অল্পকথায়, মানুষের নিজস্ব  পূর্বপুরুষদের থেকে পাওয়া জিন, নিজ চর্চিত দর্শন, অর্জিত  চিন্তা, আকড়ে ধরা বন্ধনগুলোই মানু্ষের সুখ-দুঃখের আপেক্ষিক পরিমাণ নির্ধারন করবে।


মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত

আধুনিক আমলাতন্ত্র: ওয়েবার থেকে ইভানস

চেপে রাখা অর্থণীতি: মুক্তবাজারের মিথ্যাবাজার

জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কথন

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

বিনির্মাণঃ ধ্বংসাত্মক সমালোচনার বৈধতা

সজল রোশানের ' রিলিজিয়াস মাইণ্ডসেট' কেমন?

ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রচিন্তা: আলথুসেরের রাষ্ট্রপাঠ