অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকি


সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশের সামগ্রিক সাফল্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। এটি এখন বিশ্ব স্বীকৃত। বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়া, শিশুমৃত্যু ইত্যাদি সমস্যা দূরীকরণে আইন প্রয়োগ ও সরকারি ব্যবস্থা গ্রহণ দৃশ্যমান ভূমিকা রেখে আসছে। পাশাপাশি সমস্যাগুলো নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি সব সময়ই কার্যকর ভূমিকা পালন করছে। দেশের মোটামুটি সব নাগরিক সমস্যাগুলোর কথা এবং এর প্রতিরোধের উপায় এরই মধ্যে জেনে গেছে। ফলে এসব ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) থেকে আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম একটি লক্ষ্য হচ্ছে সবার জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্য অর্জনের সঙ্গে অন্য প্রায় সব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশে নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যগত, সামাজিক ও পরিবেশ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবার জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার লক্ষ্যটি ক্রমান্বয়ে ধূলিসাৎ হয়ে যেতে পারে যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার এবং এই অপব্যবহারের বিরুদ্ধে সচেতনতার মারাত্মক অভাবের কারণে।

দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের সাংঘাতিক অপব্যবহার অণুজীববিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে খুব করে চোখে পড়ে। সবাই বিষয়টি নিয়ে মোটামুটি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে দেখলেই বুকে লাগে। অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করা হয় মূলত বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ নিরাময়ের জন্য। সঠিক রোগ নির্ণয়ের পর এটি ব্যবহার করা উচিত একদম নির্দিষ্ট পরিমাণে ডাক্তারের পরামর্শে। এর অন্যথা হওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু বাস্তবতা অনেকটাই আলাদা। প্রেসক্রিপশনে লিখে দেওয়া পুরো কোর্স অনেকেই শেষ করে না। এতে জীবাণুগুলো আহত হয়ে দমে যায়। অসুখটি সাময়িকভাবে কমে যায়। কিন্তু শরীরে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুগুলো থেকে যায়। পরবর্তী সময়ে এই আহত জীবাণুগুলো একই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলে এবং ওই অ্যান্টিবায়োটিক আর সেই নির্দিষ্ট জীবাণুগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করে না। নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারের কারণে একটি অণুজীব একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলে। তৈরি হয় সুপারবাগ। এ ছাড়া অনাকাঙ্ক্ষিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার দেহে ও পরিবেশে উপকারী অণুজীবকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করে ক্ষতিকর অণুজীবগুলো চুপ করে বসে থাকে না। এদের প্রতিরোধক্ষমতার বৈশিষ্ট্যধারী গোলাকার ক্ষুদ্র ডিএনএ কণা বা প্লাজমিড পরিবেশের অন্য অণুজীবগুলোয় ব্যাপক আকারে স্থানান্তর করে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধক্ষমতা ছড়িয়ে দেয়। এ রকম একাধিক প্লাজমিড একটি অণুজীবে ঢুকে গেলে অণুজীবটি হয়ে যায় মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জীবাণু। উচ্চমাত্রায় একাধিক অ্যান্টিবায়োটিকেও অণুজীবগুলো আর ধ্বংস হয় না।

কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, দেশের জনগণের বিরাট একটি অংশ মুড়ি-মুড়কি-বাতাসার সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো পার্থক্য করে না। একটু জ্বর হলো, যাই কয়েকটা কিনে নিয়ে আসি। অলিগলির ডিসপেনসারিগুলোও যেন বসে থাকে এমন খদ্দেরের আশায়; যদিও কেউই জানে না ভাইরাস জ্বরে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো কাজ নেই। অনেক সময় আমাদের হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর নোংরা পরিবেশের কারণের উদ্ভূত নসোকমিয়াল ইনফেকশন বা হাসপাতালজাত রোগজীবাণুর ভয়ে বাড়তি অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব না করে উপায় থাকে না। দেশের সব হাসপাতাল-ক্লিনিকে যথাযথ আবর্জনা ব্যবস্থাপনা সিস্টেম নেই। সেখান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী রোগজীবাণু ছড়ায়।

গত ৩০ বছরে নতুন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়নি। কিন্তু আমাদের দেশের অনেক জীবাণু প্রথম কয়েক প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা গেছে। ফলে আমাদের দেশে এরই মধ্যে বহু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী অণুজীব তৈরি হয়ে গেছে। আশপাশে হরহামেশাই দেখা যায়, দু-চারজন মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্স টিবি, নিউমোনিয়া গনোরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। দেশে সবচেয়ে হুমকির মুখে আছে নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা উচ্চমূল্যে বা অধিকতর মূল্যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিকগুলো কিনে খেতে পারবে না। আদতে এগুলো দেশে পাওয়াই যায় না। দেশে পাওয়া যায় সর্বোচ্চ চতুর্থ প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক।

সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক পরিবেশে ছড়ানোর আগে যথাযথ ট্রিটমেন্ট দিয়ে ছাড়ার ব্যবস্থা করা জরুরি। দেশে কোন অ্যান্টিবায়োটিক কী পরিমাণ ব্যবহূত হচ্ছে, কোন কোন অণুজীব প্রতিরোধক্ষমতা অর্জন করেছে, কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিকের তালিকা—দেশব্যাপী এসব নিয়ে বড় মাপের গবেষণা প্রয়োজন। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যভাণ্ডার অনুযায়ী ডাক্তার ও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারকারীদের জন্য ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করা দরকার। পরিচিত অ্যান্টিবায়োটিক কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেললেই তা বাজারে বিক্রি বন্ধ করে দিতে হবে। বিরতি দিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় পর আবার বিক্রি করা যেতে পারে। প্রোবায়োটিক বা বন্ধু অণুজীব অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। উপযুক্ত ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া খুব জরুরি।

সার্বিকভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ ও সরকারি কার্যক্রমই যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি দরকার ব্যাপক সচেতনতামূলক কার্যক্রম। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। সবাইকে সংযুক্ত করে সার্বিক সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব। লেখক নিজেও অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার প্রতিরোধ আন্দোলন— ঝঃড়ঢ় অহঃরনরড়ঃরপ অনঁংব নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের অনুসারী। এ ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যার বিষয়ে এনজিওগুলোর সচেতনতামূলক কার্যক্রম প্রশংসনীয়। এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য দাতাগোষ্ঠী থেকে তারা সহজেই ফান্ড সংগ্রহ করে দেশের স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। মূলধারার সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করে দেশের সর্বস্তরের নাগরিকদের সমস্যাটির গভীরতা বোঝানো ও সমাধান দেওয়া সম্ভব। সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলেই এ গুরুতর সমস্যা নির্মূল করে দেশের জনস্বাস্থ্যকে মহামারির মতো হুমকির হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব। দ্রুত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়নে একদিকে বাঁচবে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ; অন্যদিকে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রাও বেঁচে যাবে সঙ্গে সঙ্গে। এসডিজি অর্জনের পথে আমরা এগিয়ে যাব আরো এক ধাপ।


মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত

আধুনিক আমলাতন্ত্র: ওয়েবার থেকে ইভানস

চেপে রাখা অর্থণীতি: মুক্তবাজারের মিথ্যাবাজার

জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কথন

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

বিনির্মাণঃ ধ্বংসাত্মক সমালোচনার বৈধতা

সজল রোশানের ' রিলিজিয়াস মাইণ্ডসেট' কেমন?

ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রচিন্তা: আলথুসেরের রাষ্ট্রপাঠ