শোধিতে হইবে ঋণ: সবাই জানুক ঔপনিবেশতার নির্মমতা

১৬৫০ সালের দিকে পৃথিবীর একটি অংশ সভ্যতা ও উন্নতির চরম শিখরে। এলাকাটি খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রাচুর্যতা ও  বৈদেশিক বাণিজ্যে সফলতা সারাদুনিয়া হতে ব্যবসায়ী,  শিল্পী,  স্থপতি, চাকুরীপ্রার্থীদের আকর্ষণ করেছিলl   পৃথিবীর এক উন্নত সভ্যতা হিসেবে জ্বল জ্বল করছিল।

অন্যদিকে পৃথিবীর অন্য একটি অংশ সামন্ত-শ্রেণী প্রথায়  জর্জরিত, ক্ষুধা অভাব ক্লিশট; যাদের শক্তিশালী রাষ্ট্রীয়  কোন আর্থ-সামাজিক কাঠামো গড়ে উঠেনি। নাগরিকদের সামান্য জীবিকার জন্য সারাদুনিয়ায় হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়। উল্লেখিত প্রথম  জায়গাটি ভারতবর্ষ। দ্বীতিয়টি ইংল্যান্ড, তখন পর্যন্ত যাদের শক্তিশালী রাষ্ট্রীয়  কোন আর্থ-সামাজিক কাঠামো গড়ে উঠেনি।

১৭০০ সালের দিকে আওরঙ্গজেবের শাসনামলে সারাপৃথিবীর মোট জিডিপির ৩২% ছিল ভারতবর্ষের, মাত্র ৩% ছিল ইংল্যান্ডের।

কিন্তু এরপর ১৭৫৭ হতে১৯৪৭ এ ১৯০ বছরে হিসেব পুরো উলটে যায়।  দুশতকের ব্রিটিশ শাসন তছনছ করে দেয় উপমহাদেশের আর্থিক ও  সামাজিক কাঠামো। ধ্বংস করে দেয়া হয় মসলিন,  জামদানি, মসলা,  খাদ্যশস্য, স্টিল,  কৃষি, জাহাজ নির্মানসহ নানা ধরণের শিল্প ও বানিজ্যিক কাঠামো। চালু করে দেয়া হয় চড়ামুল্যে ব্রিটেনে উৎপাদিত পন্য।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ১০০ বছর ও পরে ব্রিটিশ রানীর অধীনে ১০০ বছরের ইতিহাস ভারতের বঞ্চনার ইতিহাস। ক্ষমতা দখলের পর পরই জমির মালিকানা জনগনের হাত থেকে কেড়ে নেয়া হয়। ট্যাক্স আরোপ করা হয় উতপাদিত ফসলের অর্ধেক পর্যন্ত। নির্মমভাবে শোষন করে সমস্ত টাকা পাঠিয়ে দেয়া হয় ইংল্যান্ডে, সে টাকায় তারা গড়ে তুলেছে নিজের দেশকে। সুজলা সুফলা ভারতে দেখা দেয় একের পর এক প্রলয়ঙ্কারী দুর্ভিক্ষ, ১৯০ বছরে দুর্ভিক্ষে মারা যায় সাড়ে পাচ কোটি ভারতীয়। মেরে ফেলা হয় এ দেশের মানুষের আত্ববিশ্বাস, ভাত্তৃত্ববোধ, ধর্মনিরপেক্ষতা, বৈচিত্রতা, সৃজনশীলতা। 

শোসনের সুবিধার্থে হাজারো বছরের ধর্মীয় সহাবস্থানের মাঝে বিভেদের দেয়াল তুলে দেয়া হয়৷ যখন যাকে কাজে লাগে তাকে কাছে রেখে বাকিদের একে অন্যের পেছনে লাগিয়ে দেয়া হয়। দুশ বছর তাই তারা একসাথে হয়ে সর্বভারতীয় কোন সফল বিপ্লব গড়ে তুলতে পারেনি, বরংচ গোত্রীয় সুবিধার ভাগ পাওয়ার আশায় একে অপরের পিঠে ছুরি মেরেছে।

ঔপনিবেশিক শাসনের সাফাইকারীরা বলতে চান, রেল, শিক্ষা, গণতন্ত্র, সাহিত্য, আধুনিক দর্শন  বাকস্বাধীনতা, সতীদাহপ্রথা রোধ,  চা, ক্রিকেট এমনকি সর্বভারতীয় ধারণাও উপমহাদেশের জন্য ইংরেজদের উপহার। বাস্তবতা হলো ইংরেজরা কোন কিছুই ভারতীয়দের স্বার্থে করেনি। ভারত থেকে তারা যা আয় করত তার পুরোটাই পাচার করেছে। ভারতীয় শিক্ষা,  রাস্তাঘাট,  স্বাস্থ্য, ত্রাণ সকল  কিছুতেই তারা কোন ব্যয়কে অপচয় মনে করত। রেল লাইন ছিল তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বা রিসোর্স সংগ্রহ করে নিয়ে জাহাজে তুলে দিয়ে ইংল্যান্ডে পাঠানোর একটা উপায় মাত্র। দুটি বিশ্বযুদ্ধেই তারা এটি করেছে।  সারাদুনিয়ায় ভারতীয়দের সৈন্য হিসেবে  পাঠিয়েছে।  সকলের জন্য রসদ পাঠিয়েছে এখান হতে তুলে নিয়ে। দু দুটি বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশদের পক্ষ নিয়ে মারা পড়েছে প্রায় দেড়লাখ সৈন্য, আহত পঙ্গু হয়েছে আরো কয়েকগুণ। ব্রিটিশের ইতিহাসে এগুলো ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলে দেয়া হয়েছে।  সারাদুনিয়ায় সকল কলোনীগুলোর জন্য জোর করে শ্রমিক পাঠিয়েছে এখান হতে, লাখ লাখ মানুষকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে হত্যা করেছে। ততটুকুই শিক্ষা দিয়েছে যতটুকু তাদের সাম্রাজ্য ধরে রাখার জন্য তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় দেশিয় জনশক্তি যোগানের জন্য।  তাদের তৈরি আইনগুলো ছিল বৈষম্যমূলক,  প্রয়োগ ছিল নির্মম বৈষম্যমূলক।  বিচারে দেশিয়দের দ্বারা ইংরেজদের বিচারের কোন সুযোগ ছিল না, তাই তাদের সকল অপকর্মগুলোর বিচার ছিল না।স্থানীয়দের প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কোন্ পদও দেয়া হত না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিরাট সেনাবাহিনীর জন্য ভারতে কাজ করার জন্য উপযুক্ত সংখ্যক ইংরেজে পাওয়া না যাওয়ায়,  কিছু ভারতীয়দের কিছু কিছু প্রশাসনিক পদ দেয়া হতো।

তারা ভারতছাড়ে প্রধানত দুটি কারণে। এক, দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বৈশ্বিক চাপ, দুই, সেনাবাহিনীতে দেশীয় সেনাদের বিদ্রোহ। আসলে ভারত তাদের বিশফোড়া হয়ে উঠেছিল। যাওয়ার সময় এদেশের মাত্র ১৬% লোক শিক্ষিত, ৯৫% লোক দরিদ্রসীমার নিচে। সারাদুনিয়ায় ভারতের জিডিপির ভাগ নেমে আসে  মাত্র ৪% এ।  ধর্মের জিকিরে পুরো ভারতবর্ষকে দুভাগে ভাগ করে দিয়ে যায়। একসময়ের সভ্যতা ও উন্নয়নের বিস্ময় ভারতবর্ষ হয়ে যায় ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের পোস্টার। রিক্ত ও নিঃস্ব হয়ে যাওয়া ভারতের হীরার টুকরা কোহিনুরকে যেমন লুটে নিয়ে ব্রিটেনের রানীর মাথায় পড়িয়ে দেয়া হয়, তেমনি এদেশের সকল সম্পত্তি পাচার করে ব্রিটেনকে সৌন্দর্যমন্ডিত করা হয়েছে। ভারতের পাচারকৃত সমপত্তিগুলো ব্রিটেনের বন্দরগুলোতে খালাস করতে গিয়ে ৩/৪ মাস ধরে জাহাজজট তৈরি হয়ে যেত।

দুইশ বছরে পাচার করেছে বর্তমান বাজারমুল্যে তিন ট্রিলিয়ন ডলার, যা ব্রিটেনের ২০১৫ সালের জিডিপির চাইতেও ঢের বেশি।

শশী থারুর এসকল অপরাধের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। যেহেতু এখন আর সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দেয়া, অথবা যথার্থ পরিমান নির্ধারণ করা বা বাংলাদেশ,  ইন্ডিয়া,  পাকিস্তান দেশগুলোর কার হিস্যা কতটুকু সেটা বের করা মহা জটিল, তাই তিনি বিকল্প কিছু উপায় বাতলে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন প্রতিকী বা সেলামী  মুল্যে দুশো বছর ধরে একটাকা দিলেই হবে। সেটা না দিলে জাতি হিসেবে ইংল্যান্ড সরকারকে স্যরি বলতে হবে,  যেমন স্যরি বলেছে জার্মানরা হলোকাস্ট জাতীয় অপরাধের জন্য, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো স্যরি বলেছেন কোন এককালে ভারতীয়দের ইমিগ্রেশন করতে বাধা দেয়ার জন্য। সবচেয়ে বেশি  ঋণ শোধ হবে যদি ইংল্যান্ড তার এ প্রজন্মকে পাঠ্যবইয়ের ইতিহাসে ঔপনিবেশিকতা জারিত কুকর্মের নির্মোহ বর্ণনা দিয়ে প্রকৃত ঘটনা জানাতে সাহায্য করে।

সবাই জানুক ঔপনিবেশতার নির্মমতা।


মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত

আধুনিক আমলাতন্ত্র: ওয়েবার থেকে ইভানস

চেপে রাখা অর্থণীতি: মুক্তবাজারের মিথ্যাবাজার

জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কথন

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

বিনির্মাণঃ ধ্বংসাত্মক সমালোচনার বৈধতা

সজল রোশানের ' রিলিজিয়াস মাইণ্ডসেট' কেমন?

ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রচিন্তা: আলথুসেরের রাষ্ট্রপাঠ