বুদ্ধিজীবীদের হত্যাঃ বিনি সুতার মালাটি গাথা হলো না

কেন হত্যা করা হয়েছিল বুদ্ধিজীবীদের? প্রশ্নের উত্তর সহজ, একটি জাতির উন্নয়ন-অগ্রগতিকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য।  এটি সাধারণ ধারণাগত উত্তর, তবে এই ডিসকোর্সের বুদ্ধিবৃত্তিক  ভিত্তিমুল অনেক গভীরে প্রোথিত। পৃথিবীর উন্নয়ন ও রাজনৈতিক  ইতিহাসের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বুদ্ধিজীবী, চিন্তকদের অবদানগুলো। এ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা প্রবাহিত হয় প্রজন্ম হতে প্রজন্মান্তরে ।

আজ হতে প্রায় ২৭০০ বছর পূর্বে ভারতীয় লিখিত দর্শনের ভিত্তিমূল উপনিষদগুলো রচিত হয় অজানা লেখকদের হাতে। তাদের এ শিক্ষা ও চিন্তা এসেছে বৈদিক দার্শনিকদের প্রস্তাবনাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে। বৈদিক, জৈন, বৌদ্ধ ও উপনিষদের দর্শন ও চিন্তাসমূহ এসেছে পরম্পরা ধরে। প্রায় ২৪০০ বা ২৫০০ বছর আগে, সিদ্ধার্ত গৌতমা নেপালের লুম্বিনি ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন নির্বাণ লাভের দীক্ষা দিতে। এই দর্শনগুলোই পরবর্তীতে ছডিয়ে ছিটিয়ে পড়েছে সারাদুনিয়ায়। মানুষ চিন্তা করতে শিখেছে তাদের দীক্ষায়। তাদের শিষ্য বা সমসাময়িকরা- যেমন অজিত কেশ, পায়াসি, কপিল, কণাদ, নাগসেন, বুদ্ধঘোষ, ভদন্ত, সঞ্জয়, মকখলি গোসাল, যশোমিত্র এ চিন্তাগুলোকে ঋদ্ধ করেন। আর্যভট্ট , চানক্য,  ভাসকরাদের বস্তুবাদী ও গাণিতিক দর্শন বয়ে এসেছে তাদের মাধ্যমে।

এখনকার উন্নত  ইউরোপ এমেরিকায় যখন অধিকাংশ মানুষ গভীর জংগলে আদিম শিকারী-সংগ্রাহক ছিল, তখন এ উপমহাদেশে জন্ম নেয় সিন্ধু, মহেন জা দারো,  হরপ্পাসহ অনেক উন্নত সভ্যতার। এগুলো হাঠৎ মাটি ভেদ করে উঠে আসা কোন কিছু না, এগুলো ছিল মহান চিন্তক ও দার্শনিকদের গভীর  জ্ঞানের আলো।

প্রায় সাড়ে পচিশশত বছর পূর্বে চৈনিক দার্শনিক কনফুসিয়াস তার দর্শন প্রচার করে গেছেন। কনফুসিয়াস, লাউজু, সানজুদের উত্তরসুরী হচ্ছেন  সান ইয়াত সেন, মাও সে তুং।   চিন্তার ও এক্টিভিজমের উত্তরসূরী। আধুনিক চায়না, জাপান , কোরিয়া তাদের চিন্তার ফসল।

সক্রেটিসদেরও আগে থেলিসের হাত ধরে গ্রিক তথা পাশ্চাত্য দর্শন শুরু হয় প্রায় ২৬০০ বছর পূর্বে। এনাক্সিমেন্ডার, পিথাগোরাস, লিউসিপাস, ডেমোক্রিটাসদের মত চিন্তকরা তার পূর্বসূরীদের চিন্তাকে প্রশ্ন করে নতুন উত্তর খুজেছেন। সক্রেটিস- এরিস্টটল- প্লেটো পূর্বসুরীদের চিন্তাকে আপডেট করে আধুনিক ইউরোপীয় চিন্তাধারার  ভিত্তি স্থাপন করেছেন। এদের চিন্তার ফসল রেনে দেকার্ত, এমানুয়েল কান্ট, হেগেল, নিটশে, মার্কস, এংগেলস, জন লক, হবস, রাসেল, এডাম স্মিথ, জাক লাকা, ফুকো, দেরিদা, ফ্রয়েড, নিউটন, ট্রটস্কি, এডোয়ার্ড সাইদ, আইন্সটাইন, রুশো, ভালতেয়ার এর চিন্তা ও প্রস্তাবনাগুলো। যদি পাশ্চাত্য সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে স্বীকার করেন, তাহলে মনে রাখতে হবে- এসব মহান মনীষীদের চিন্তার উৎপাদ হচ্ছে পশ্চিমের প্রাধান্য, হেজেমনি ও উন্নয়ন।

গ্রিক দর্শন ও জ্ঞান চর্চা হতে অনুপ্রাণিত হয়ে ৮০০-১৩০০ সাল পর্যন্ত জ্ঞান চর্চার আধার হয় ইসলামী সভ্যতা। সেমেটিক ধর্মগুরুদের  সাথে আধুনিক বিজ্ঞান-দর্শন চিন্তার  মিথষ্ক্রিয়া ঘটে। ইমাম গাজ্জালি, ইবনে সিনা , ইবনে রুশদ, আল হাসান, আল খারিজমি, রুমি এদের মাধ্যমে ইসলামি সভ্যতার প্রভাব বিস্তৃত হয় সারা দুনিয়াজুড়ে। যতদিন এ জ্ঞানচর্চা ও চিন্তা বেগবান ছিল, ততদিন আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি ইসলামী সাম্রাজ্যের।

রোমান চিন্তার আদিপূরুষরা হচ্ছেন সিসেরো, মার্কাস অরেলিয়াস, এপিক্টেটাস, সেনেকারা। ম্যাকিয়াভেলি, গ্রামসি, আগামবেন, বেনোদিত্ত ক্রোচে, থমাস একুইনাস, জিওর্দানো ব্রুনো ও সিসেরা বেকারিয়াদের চিন্তা ও উদ্ভাবন হটাত করে পাননি, এগুলো তাদের পূর্বসূরিদের লিগ্যাসি।

এবার আসি যারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে তাদের চিন্তার জগতটি কেমন ছিল। উর্দু কবি আল্লামা ইকবাল ছিলেন পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের আধ্যাত্মিক নেতা। তিনি একাধারে ছিলেন কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, নেতা, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক। মুসলিমদের জন্য পৃথক দেশের ধারণা তার চিন্তাপ্রসুত।  যদিও  উড়ে এসে জুড়ে বসা জিন্নাহর পাকিস্তানের ইতিহাস জিন্নাহময়, এতে ইকবালের ঠাই নাই। ইকবাল ছিলেন মহান চিন্তক ও কবি মির্জা গালিভ এর ভক্ত। গালিভ বহন করেছেন আমির খসরু, মীর তকি মীরদের চিন্তার উত্তরাধিকার।  এমনকি পরবর্তিতে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ  বা আহমেদ ফরাজ সহ বহু সাহিত্যিক চিন্তক ছিলেন ইকবাল, গালিভ  দ্বারা অনুপ্রাণিত।

অর্থাৎ,  মানুষ একা চিন্তা করতে শিখেনা, তার চিন্তাগুরু লাগে, বাতিঘর লাগে, আইকন লাগে। চিন্তা পূর্বসুরীদের থেকে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রবাহিত হয়। বিচ্ছিন্ন চিন্তার ফুলগুলো জোড়া লেগে লেগে দর্শনের মালা হয়ে যায়।  চিন্তা  ও জ্ঞানচর্চা ব্যাপকভাবে গুরুমুখী। বিপ্লব বা  আন্দোলন-ও তাই। ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব,  সিপাহী বিপ্লব, ফকির বিদ্রোহ, ফারায়েজি আন্দোলন, সত্যাগ্রহ,   ভারতছাড় আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও সারা দুনিয়ার কলোনী বিরোধী আন্দোলনগুলোর দীক্ষা  হতেই উতসারিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের মুক্তি আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধ। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সুবাস চন্দ্র বসু, মাওলানা আজাদ, হাজী শরিয়তুল্লাহ, তিতুমীর, ক্ষুদিরাম, নেহেরু, মাও সে তুং, চে, ফিদেল, মাওলানা ভাসানী, শেরেবাংলা, রবীন্দ্র, নজরুল প্রমুখের চিন্তা ও এক্টিভিজম প্রভাবিত করেছে বঙ্গবন্ধু ও তার অনুসারীদের। বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখাগুলো পড়লেই পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।

বিজয়ের প্রাক্কালে প্রায় ১১০০ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলির  হঠাৎ রাগের বশে নেয়া কোন সিদ্ধান্ত নয়। প্রকৃতপক্ষে অনেক আগে থেকেই রবীন্দ্রনাথকে হিন্দু কবি, বাংলাকে হিন্দুর ভাষা, এদেশের মানুষকে তৃতীয় শ্রেণির মানুষ হিসেবে অবজ্ঞার চোখে দেখত পাকিস্তানিরা ও পাকিস্তানপন্থীরা। তাদের চিন্তার কাউন্টার দর্শন হলো জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র, সাম্য ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ চিন্তার চিন্তক ও এক্টিভিস্টদের মধ্যে ছিলেন প্রায় বিশ হতে পচিশ হাজার সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিত্সক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক-সংগীত ও শিল্পকলার অন্যান্য শাখার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি। আলবদর ও আলশামসসহ অন্যান্য দোসরদের হাতে  একাত্তরের জুলাই মাসের মধ্যে তুলে দেয়া হয় তাদের তালিকা। তখন থেকেই শুরু হয় তাদের কিলিং মিশন। ঐসময় মোবাইল ফোন ট্র্যাকিং বা অন্য কোন উপযুক্ত প্রযুক্তি ছিলনা, তাই হঠাৎ করে তাদের খুজে বের করা সম্ভব হয়নি। যখন পাকিস্তানি বাহিনীর দুয়ারে পরাজয় কড়া নাড়ছিল, তখন তারা একেবারে শেষ দিকে এসে হন্যে  হয়ে যায়, দলে দলে চলে বুদ্ধিজীবী নিধন। পুরো মিশন সম্পন্ন না  হলেও টপ লিস্টেডরা শিকার হয়েছেন নির্মমভাবে।

দার্শনিক এডোয়ার্ড সাইদ মনে করেন, প্রতিটি বিপ্লব- প্রতিবিপ্লবের বাবা-মা হচ্ছে চিন্তকেরা। শুধু বাবা-মা নয়-- ভাই-বোন , ভাগিনা, ভাতিজীও হচ্ছেন বুদ্ধিজীবীরা।  পাকিস্তানীরা বুঝতে পারে, বাংলাদেশের বিজয় অবিসম্ভাবী। একটি স্বাধীন দেশের চিন্তার, উন্নয়ন ও প্রগতির নেতৃত্ব দেবে এই বুদ্ধিজীবীরা, তাই তাদেরকে নিধন করতে পারলেই ভেংগে যাবে একটি স্বাধীন দেশের মেরুদন্ড।

তারা সফল হয়েছিল।

গোবিন্দ চন্দ্র দেব, মুনীর চৌধুরী , মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ,আনোয়ার পাশা, আবুল খায়ের, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, সিরাজুল হক খান, শহীদুল্লাহ কায়সার, নিজামুদ্দীন আহমেদ, সেলিনা পারভীন প্রমুখদের মত প্রধানতম প্রায় ১১০০ চিন্তকদের যে শুন্যতা তৈরি হয়েছিল, জাতি তার মাশুল দেয় পদে পদে। পচাত্তরে জাতির পিতার পরিবারের হত্যাকান্ড, উপর্যুপুরি সামরিক ক্যু ও অগণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতাদখল দেশের কাংখিত অগ্রগতির ধারাকে নস্যাৎ করে দেয়। এসব প্রতিক্রিয়াশীলদের উত্থানের কাউন্টার ইন্টেলেকচুয়াল শক্তি বাংলাদেশে ছিল না। অর্ধ-সেমি বুদ্ধিজীবীরা সামান্য ক্ষমতার স্বাদ ও গন্ধ পাওয়ার লোভে প্রতিনিয়ত ডিগবাজি খাচ্ছিল ক্ষমতাশীলদের পায়ে পায়ে।  একটি বুদ্ধিজীবী প্রজন্মকে নিধন করার পাশাপাশি হত্যা করা হয়েছিল তাদের উত্তরাধিকারকে। তাদের থেকে দেখে শিখতে পারবে -এমন একটি জেনারেশনের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার  প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ( Cessation of the Intellectual Legacy)

বাংলাদেশের দুটি বড় ঐতিহাসিক অর্জনের দিন  হচ্ছে ২৬শে মার্চের স্বাধীনতা দিবস ও ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ২৫শে মার্চের রাতে বাঙালির কন্ঠরোধ করার জন্য হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা  কন্ঠরোধ করা যায় নি, ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়।  এ বিজয়ের আগে আমাদের মেরুদন্ড ভেংগে দেয়ার জন্য ১৪ই ডিসেম্বরে  এ দেশের প্রধান বুদ্ধিজীবীদের নিধন করা হয়। বুদ্ধির ফুলগুলো দিয়ে চিন্তার মালা গেথে দেশকে সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত করা যায় নি, ছিড়ে ফেলা হয়েছে বিনি সুতাটি। 

আশা করি, প্রকৃত দেশপ্রেমিক নেত্তৃত্ব, উদারগণতান্ত্রিক মুক্তবুদ্ধির চর্চা এ ক্ষতকে সারিয়ে তুলবে ধীরে ধীরে। ধীরে ধীরে ছিড়ে ফেলা মালাটি আবার জোড়া লাগাবে।  বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার গ্যাপ পুরণ করে নতুন এক ঝাক চিন্তক-এক্টিভিস্টরা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে।

শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মত্যাগ সফল হোক।


মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত

আধুনিক আমলাতন্ত্র: ওয়েবার থেকে ইভানস

চেপে রাখা অর্থণীতি: মুক্তবাজারের মিথ্যাবাজার

জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কথন

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

বিনির্মাণঃ ধ্বংসাত্মক সমালোচনার বৈধতা

সজল রোশানের ' রিলিজিয়াস মাইণ্ডসেট' কেমন?

ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রচিন্তা: আলথুসেরের রাষ্ট্রপাঠ