বিশ্ব অর্থণীতির উত্থান-পতন কাহিনী ও ভবিষ্যৎ
একটি দেশের উন্নয়ন বা দারিদ্র দৈবাৎ কোনো ঘটনা নয়।ম্যাক্রো-একনোমির নানা চলক বিশ্লেষণ করে একটি দেশের অর্থনৈতিক অতীত-বর্তমান বিশ্লেষণ ও অদূর ভবিষ্যৎ অনুমান করা যেতে পারে। তবে যে কোন অনুমান ৫-১০ বছরের জন্য কার্যকরী হলেও লম্বা সময়ের জন্য সঠিকভাবে অনুমান করা মোটামুটি অসম্ভব।
একটি দেশের অর্থনীতির গতিপথ নির্ধারণ করে এর পপুলেশন ডিভিডেন্ট, বিনিয়োগ-জিডিপি রেশিও, ঋণ- জিডিপি রেশিও কিংবা- মুদ্রাস্ফীতি জিডিপির প্রবৃদ্ধির তুলনায় কেমন করছে তার হিসেব। দেশটি দরিদ্র হলে আসলে সে ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজের ভিত্তিটা কেমন তৈরি করছে, সেটার ভিত্তি যত শক্ত হবে তার উপর তার উপরের উঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে। দেশের যে সব ধণিকশ্রেণি তৈরি হয়েছে, তাদের সম্পদ কিভাবে তৈরি হল এটাও অর্থণীতির ভবিষ্যত কোনদিকে যাবে তা নির্ধারণ করবে। দেশের অর্থনীতি বেশি সরকারী কর্মকান্ড বা মাতব্বরীর উপর নির্ভর করলে সে দেশে উচ্চ টেকসই উন্নয়ন কঠিন। এর বাইরে দেশের অর্থনীতির গতিনির্ধারক হচ্ছে গতিশীল উন্নয়নকামী নেতৃত্ব, বাণিজ্যিক যোগাযোগের উপযুক্ত ভৌগলিক অবস্থান, ডলারের সাথে মুদ্রার মুল্যমান ইত্যাদি।
একটি দেশের কর্মক্ষণ জনসংখার অনুপাত অর্থণীতির প্রাণ। পরিমিত হারে হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি অর্থনীতির জন্য উপাদেয়। বেশিরভাগ উন্নতদেশগুলোতে জনসংখ্যা হ্রাস অর্থণীতির গতির লাগাম টেনে ধরেছে। রিটায়ার্ড মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। নানা প্রনোদনাতে কাজ না হলেও কোন কোন দেশ ইমিগ্রেশন ও রেফিউজি সিস্টেমের মাধ্যমে একটি ভারসাম্য রক্ষার চেষ্ঠা করছে। এ প্রেক্ষিতে যতবেশি নারী ও বয়সীদের শ্রম শক্তিতে রাখা যায় অর্থণীতির জন্য ভাল। উদাহরণ, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে নারী-পূরুষ সম্মিলিত কর্মধারী জনসংখ্যার শতকরা হার বেশি হওয়ায় অর্থণীতির নানা পরিমাপে বাংলাদেশের পারফর্মেন্স ভাল।
একটি গরীব দেশের উন্নত দেশ হতে টানা ২৫/৩০ বছর ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬% এর উপর থাকা দরকার। প্রবৃদ্ধি জন্য প্রয়োজন সরকারী-বেসরকারী বিনিয়োগ। এর একটি আদর্শ মাত্রা হলো জিডিপির ২৫-৩৫%। কম হলে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে, বেশি হলে তারল্য সংকটসহ নানা ধরণের অর্থনৈতিক বাবল তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশে এটি ৩০% এর কাছাকাছি।
একটি গরিব দেশ সাধারণত কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতি হতে শ্রমবহুল ইন্ডাস্ট্রিতে এগিয়ে যায়, এরপরের ধাপ হল লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং। এবং উন্নয়নের সর্বশেষ ধাপ হল ভারী শিল্পকারখানা ও প্রযুক্তিগত উতকর্ষতা। একধাপ মিস করে অন্যধাপে গেলে প্রবৃদ্ধি টেকসই হয় না। বাংলাদেশ ভিয়েতনাম ২য় ধাপে শক্তি বৃদ্ধি করে আগালেও ভারত ২য় ধাপ বাদ দিয়ে ৩য় ধাপে অধিক মনোযোগী হওয়ায় তাদের প্রবৃদ্ধিতে সাময়িকভাবে ভাটা পড়েছে।
ঋণ করে ঘি খাওয়া অর্থণীতির জন্য প্রয়োজন। তবে পরিমিত খাওয়া উপাদেয়। টানা পাচ বছর ঋণের হার জিডিপির হারের বেশি হলে ধরে নেয়া যেতে পারে সামনে খারাপ সময় আসছে। যেমনটা হয়েছে শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে। অতি বড় অর্থণীতির এটি বহন করার ক্ষমতা থাকলেও উন্নয়নশীল অর্থনীতি এটা লম্বা সময় ধরে সহ্য করতে পারে না, মুখ থুবড়ে পড়ে।
কোন দেশের স্বাস্থ্যকর অর্থনীতির লক্ষণ হচ্ছে লম্বা সময় ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও নিম্ন মূল্যস্ফীতি। জিনিসপত্রের দাম হুহু করে বাড়লে জনগণ ক্ষেপে যায়, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, অথবা সরকার জনগণকে চাপে রেখে কাজ চালিয়ে যায়, কিন্তু অর্থনীতির পলিসিগুলো, বাজেট ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সঠিকভাবে কাজ করে না। অর্থনীতি আরো গর্তে পড়ে যায়। টানা পাচ বছর ধরে প্রবৃদ্ধির তুলনার মুদ্রাস্ফীতি একটি অশনিসংকেত। যেকোন সময় উন্নয়নের বাবল ফেটে যেতে পারে।
অর্থণীতির অদূর ভবিষ্যৎ বোঝার জন্য সেদেশের অতিধনীরা কিভাবে সম্পদ অর্জন করছে সেটা বোঝা জরুরি। তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদের উপর ভিত্তি করে বা বিভিন্ন সরকারী আনুকুল্যে অথবা কানেকশনে যদি অতিধণীরা আরো বেশি ধনী হয় তাহলে বুঝতে হবে সে সিস্টেমে সমস্যা আছে। এটা লম্বা সময়ের জন্য টেকসই নাও হতে পারে। ব্যাপক অসমতা ও বঞ্চনা তৈরি হয় সুবিধাভোগী নিপিড়ক গোষ্ঠী তৈরি হয়, উন্নয়নের সুফল সবার হাতে পৌছায় না।
অর্থণীতির দুইটা হাতিয়ার হচ্ছে মানিটারি পলিসি ও ফিসক্যাল পলিসি। সরকারের খাতভিত্তিক বাজেট ব্যয় বাড়ানো কমানো, ঋণ নেয়া দেয়া, ট্যাক্স কমানো বাড়ানো কমানো ইত্যাদি হচ্ছে ফিসক্যাল পলিসি। আবার কেন্দ্রিয় ব্যাংক সুদের হার কমানো বাড়ানো, বাজারে টাকার সরবরাহ বাড়িয়ে মানিটারি পলিসির মাধ্যমে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এদুটো পলিসি সমন্বয় না হলে প্যাচ লেগে যায়। মুদ্রার দাম কমানো বহুল ব্যবহৃত একটি মানিটারি পলিসি। রপ্তানী আয় বেড়ে যায়, রেমিটেন্স বাড়ে, বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ে। আমদানী ব্যায়ে মোটামুটি ভারসাম্য রক্ষা করা গেলে এটা জাতীয় অর্থণীতিতে ভাল ভূমিকা রাখে। তবে কেন্দ্রিয় ও তফসীলি ব্যাংক ব্যবস্থাপনা, ঋণ প্রদান-গ্রহণ ও বিনিয়োগে সরকার যত কম নাক গলাবে অর্থনীতি নিজে নিজে ততটা বলশালী হবে। সরকারের কাজ রাস্তাঘাট, ব্রিজ, বন্দর ও সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখা, বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ তৈরি করা। বেসরকারী খাত এর উপর ভিত্তি করে অর্থনীতি এগিয়ে নেবে।
দেশের উন্নয়নে ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। দুবাই, হংকং কিংবা সিংগাপুর এর উজ্জ্বল উদাহরণ। ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞার সময়ে দুবাই ইরানের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি করে ইরানের সকল আমদানি রপ্তানির সংযোগ বিন্দু হিসেবে কাজ করে অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি প্রদান করে। চীন যখন সারাবিশ্ব থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখে হংকং সারাবিশ্বের সাথে চীনের বাণিজ্যিক যোগাযোগের বাফারিং করে। বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, শ্রীলংকার ভৌগোলিক সুবিধাজনক অবস্থান ম্যানুফেকচারিং শিল্পে ভাল সুবিধা দিতে পারে। তবে এই অবস্থানগত সুইটস্পট উন্নয়নের শেষ কথা না। সঠিক অর্থনৈতিক নেতৃত্ব, পরিকল্পনা এসকল বাধা অতিক্রম করাতে পারে। কোন দেশের উন্নয়ন নিয়ে বিশ্বমিডিয়ায় হাইপ উঠলেই সে দেশ শীঘ্রই উন্নয়নের শিখরে উঠে যাবে তেমনটা হয় খুব কালেভদ্রে, বরং হাইপ বেশি থাকলে তার উলটা গতিপথ বেশি দেখা যায়। যেমন একসময় ব্রিকস নিয়ে অনেক হইচই থাকলেও আস্তে আস্তে তা স্তিমিত হয়ে গিয়েছে।
এসব বিষয়গুলোর উপর সামগ্রিক বিশ্লেষণ করে The Rise and Fall of Nations বই এর লেখক রুচির শর্মা বিশ্বের নানাদেশের অদূর ভবিষ্যৎ দেখার চেষ্টা করেছে। তিনি ইউ এস এ, জার্মানী দেশগুলোর ভবিষ্যতে ভাল বলে অনুমান করলেও ইউরোপ, রাশিয়া, চীন, ব্রাজিল, জাপান দেশগুলোর উচ্চ প্রবৃদ্ধি দেখতে পাচ্ছেন না। অন্যদিকে মেক্সিকো, পোল্য্যান্ড, রুমানিয়া, স্পেইন, বাংলাদেশ ভিয়েতনামের ব্যাপারে পজিটিভ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন