কোরবানির অর্থনীতি

 অতিসামান্য অর্থনীতির জ্ঞান দিয়ে যা বুঝি বাজারে টাকা বা মুদ্রার ফলপ্রসু কন্ট্রিবিউশন  মাপার জন্য ব্যবহার করা হয় মাল্টিপ্লাইয়ার ইফেক্টকে।  কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ছাপানো টাকা হাতবদল হয়ে ঘুরতে থাকে-  যতবেশি হাতবদল হবে অর্থনীতি ততবেশি গতিশীল হবে। মানুষের হাতে টাকা যাবে, খরচ হবে,  আরেকজন পাবে -এভাবেই অর্থনীতি এগিয়ে যাবে।

কোন এক বড় ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ বা কালোটাকার মালিক যদি টাকা  বিদেশ পাচার করে দেয়, তাহলে মাল্টিপ্লায়ার  ইফেক্ট বন্ধ অথবা ধীর  হয়ে যায়। অপরদিকে ইদ, পহেলা বৈশাখ,  গ্রাম কেন্দ্রিক ক্ষুদ্র কৃষক, ব্যাবসায়ীর  ইনকাম, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর টাকাগুলো অনেক  বেশি হাতবদল হয়, অর্থনীতিকে প্রাণ দান করে। এই ধরুন সামান্য গরু পালনের সাথে জড়িত ঘাস-পশুখাদ্য-দুগ্ধজাতপন্য ব্যবসায়ী,  চামড়া ব্যবসায়ি,  মসজিদ- মাদ্রাসা- এতিমখানা,  ট্রান্সপোর্ট শ্রমিক, দালাল, কসাই,  রাখাল, দোকানদার ইত্যাদি। এর বাইরেও কত নাম জানা অজানা পেশার কত জন যে জড়িত তা আংগুল গুনে হিসেব করা সম্ভব না। এরা যা পায় তা দিয়ে চালু রাখে গ্রামের চাল, ডাল,  কাপড় ও নাম অজানা  কত শত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ির জীবন। এই ধরুন কোরবানীকে কেন্দ্র করে দেশে ফ্রিজের যে ব্যবসা হয় এটা আপনি ফেলে দিতে পারবেন না। এ ইদকে কেন্দ্রকরে এভাবেই টাকা ফ্লাই করে, মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট কাজ করে। আমাদের কোরবাণীর অর্থনীতির পরিমান প্রায় ৮০-৯০হাজার কোটি টাকা হলেও এর মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট অনেক বেশিগুণ। দেশের চামড়াজাত পন্য রপ্তানী ১০০ কোটি  ডলার ছাড়িয়েছে তা এই কোরবানী ইদের অবদান।

দেশ স্বাধীনের পর যে কয়টি যুগান্তকারী পলিসি ডিসিশন হয়ে হয়েছে এবং দেশের অর্থনীতির বড় একটি অংশকে নতুন করে প্রাণ দিয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল, আশির দশকে দেশের ঔষধনীতি(দেশে  এভেইলবল ঔষধ আমদানি নিষিদ্ধ করা), সহজশর্তে গার্মেণ্টসের জন্য এলসি করার সুযোগ এবং সর্বশেষ দেশে বিদেশি গরু আমদানী নিষিদ্ধ করা। এগুলোর প্রত্যেকটার টাকাগুলোর ফ্লাইং স্পেস দেখাতে গেলে বিরাট মহাকাব্য হয়ে যাবে। ঋণদাতাদের জিডিপি বা জিএনপির হিসেব, বিরাট বুদ্ধিজীবী অর্থনীতিবিদদের পত্রিকার রিপোর্ট শেষের কমেন্টারি বা মাঝের পাতার কলাম, কিংবা আধুনিক সেকুলার ও ভেজিটেরিয়ান বুদ্ধিজীবীদের পশুপ্রেম এ নিয়ে আপনাকে কোন ধারণা দিতে পারবে না। এ জানতে হলে আপনাকে এ সেক্টরগুলোর  সাথে জড়িত নিম্ন-আয়ের মানুষগুলোর সাথে মিশতে হবে, তাদের জীবন জীবিকা দেখতে হবে, বেচে থাকার সংগ্রাম উপলব্ধি করতে হবে, দিনশেষে তাদের দুবেলা ভাতের সংস্থানের পর ক্যাপ্সটান সিগারেট বা আকিজ বিড়ি টানার সুখ সন্ধান করতে হবে। আর নতুন পলিসিতে উতসাহিত হয়ে হাজার হাজার শিক্ষিত তরূন,  বেকার যুবক থেকে শুরু করে বড় বড় শিল্পদ্যোক্তারাও পশুপালনের দিকে ঝুকেছে, তাদের ব্যাবসা ও কর্মসংস্থানের কেন্দ্রবিন্দু এ কোরবানির ইদ। দেশে কমবেশি আট কোটি লোক এ শিল্পের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উপকারভোগী। গ্রামে গ্রামে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার বাণিজ্যিক খামার। শিল্পোদ্যোক্তারাও লাভের অংক বেশ মোটা ও এ খাতে করহার কম দেখে এগিয়ে আসছেন বড় আকারে ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেভেলে বিনিয়োগের। এ শিল্পের দেশের চাহিদা মেটাতে পারলে শীঘ্রই মাংস রপ্তানী পর্যায়ে যাওয়া সম্ভব।

এসব বলার উদ্দেশ্য হলো  বুঝানো সরকারের একটা পলিসি কিভাবে নিরবে নিভৃতে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। কোভিড সিচুয়েশনেও অনেক নতুন কর্মসংস্থানের সূচনা করেছে এ শিল্প। সামনের দিনে সরকারী প্রণোদনা পেলে এ শ্রমবহুল  এ খাতটি দেশের অর্থণীতির আরো একটি পিলার হিসেবে গড়ে উঠবে। পদ্মা সেতুর কল্যানে দক্ষিণ পশ্চিমের জেলাগুলোতে পশুপালন একটি রমরমা শিল্প হিসেবে উঠে আসবে বলে মনে করি।

ধান ভানতে গিয়ে আরেকটু শিবের সংগীত পরিবেশন করি,  কোরবানীর পশু কেনাবেচা নিয়ে নতুন এক ধরণের নাটক শুরু হয়েছে। উঠতি ইউটিউবার বা রিপোর্টাররা তাদের ভিউ বাড়ানো বা ভাইরালের লোভে সহজ সরল কৃষকদের দিয়ে তাদের পশুর অপ্রয়োজনীয় মার্কেটিং ও ব্রান্ডিং করে। একটু বড় সাইজের পশুগুলো নানা কিসিমের নাম দিয়ে তাদের মাধ্যমে অনর্থক আকাশচুম্বী দাম বলিয়ে নেয়। এদের দেখাদেখি অন্য কৃষকরাও মার্কেট রেটের চেয়ে বেশি দাম হাকানো শুরু করে। এরা যখন সময় শেষে বিক্রি করতে পারে না তখন হাউ-মাউ করে কান্নাকাটি করে। ইউটিউবাররা এটিকেও পরে ভাইরাল করে। অর্থাৎ তাদের লাভ দুধাপে। এ বিষয়ে সজাগ হলে সবাই বাস্তব দাম চাইবেন এবং বিক্রি ও লাভ সন্তোষজনক হবে।

##


মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত

আধুনিক আমলাতন্ত্র: ওয়েবার থেকে ইভানস

চেপে রাখা অর্থণীতি: মুক্তবাজারের মিথ্যাবাজার

জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কথন

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

বিনির্মাণঃ ধ্বংসাত্মক সমালোচনার বৈধতা

সজল রোশানের ' রিলিজিয়াস মাইণ্ডসেট' কেমন?

ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রচিন্তা: আলথুসেরের রাষ্ট্রপাঠ