জীবনানন্দ দাশের স্বরূপ
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।"-
মা কুসুমকুমারী দাসের কথা রাখতে মা ও তার নিজের প্রিয় কাজকেই শুধু কাজ মনে করে গেছেন। কাজে বড় হতে গিয়ে তিনি কথা বলাই ভুলে থাকতে চেয়েছেন। লিখেছেন কবিতা, হয়েছেন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। ইয়েটস, কিটস, এলান পো কে ছাড়িয়ে তিনি হতে চেয়েছেন গ্যোটে কিংবা হোমারের মত বড় কবি। বাংলার নির্জলা রূপ, সুনসান প্রকৃতি থেকে মানব মনের জটিল রুপ ও নানা অপ্রাপ্তির বেদনা তিনি তুলে ধরেছেন ব্যাতিক্রমি উপমা দিয়ে। সমকালীন পাঠকদের জন্য ছিল অনেকটাই দুর্বোধ্য। লিখেছেন বিশটির মত উপন্যাস, অজস্র গল্প। তবে জীবদ্দশায় প্রকাশ করার প্রয়োজন বোধ করেন নি, অথবা তিনি শুধু কবিই হতে চেয়েছেন, আর কিছু না। অপ্রকাশিত ধূসর সব গল্প উপন্যাসের পান্ডুলিপি রেখে গিয়েছেন ট্রাংকের ভেতর।
এত বড় কবিযশ, এত সুনাম, এত নামডাক, এর কিছুই তিনি দেখে যেতে পারেন নি। যাপিতজীবনে আপদমস্তক একজন ব্যার্থ মানুষ। প্রেমে ব্যার্থ, চাকুরিজীবনে অসফলতা, দাম্পত্য সুখহীন এক জীবন, এমনকি তিনি খুব ভাল স্বামী বাবা বা বন্ধু কিছুই হতে পারেন নি সারাজীবনে। কবিতা তাকে অর্থ, পরিচয়, নামডাক কিছুই এনে দিতে পারে নি, ভক্তের চেয়ে বেশী তৈরি করেছিল সমালোচক শত্রু। রবীন্দ্রবলয় থেকে বের হয়ে বাংলা কবিতাকে নতুন রুপ দেয়ার জন্য অনেকেই চেষ্ঠা করছিলেন, কিন্তু এর দায়িত্ব নিভৃতে জীবনানন্দের মত আটপৌরে, মুখচোরা, অসামাজিক ও অসফল একজনের দ্বারা সাধিত হবে তা অনেকেই মেনে নিতে পারেন নি, আর বাকিরা বুঝতেই পারেন নি।
কর্মজীবনের নানাধাপে অর্ধেক সময়ছিলেন কর্পদকশূন্য বেকার, অর্থ কষ্টে জর্জরিত থাকায় স্ত্রীর নিকট অপ্রিয় একজন স্বামী। দেশভাগে জন্মস্থান বরিশালকে হারিয়ে কোলকাতায় স্থায়ী নিবাস করার বিষয়টি তাকে আহত করেছে। নিদারূন হতাশা তাকে তাড়া করেছে সবসময়, বার বার ভেবেছেন আত্বঘাতী হওয়ার।
ধীরগতির ট্রামের ক্যাচারে বাংলাভাষার দ্বীতিয় শ্রেষ্ঠ কবি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন না আত্বহত্যা করে মোটামুটি নিভৃতে বিদায় নিয়েছেন তা আজো এক রহস্যে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন