একটা সাফ টাইটেল বনাম টাইটেল নাইন
বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলকে অভিনন্দন।
সাফ চ্যাম্পিয়ন-২০২২। সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে এ নারীদের সাফ চ্যাম্পিওনশিপের এ টাইটেলের মুল্য অপরিমাপযোগ্য।
১৯৭২ সালে কংগ্রেসে পাশ হওয়া টাইটেল নাইন আমেরিকার খেলাধুলার ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে। ওরা আইনকে নম্বর ও সাল অনুযায়ি টাইটেল বলে। এই আইনটি মুলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকল রাষ্ট্রীয় ব্যায় বৈষম্যেকে দূরীভূত করেছে। টাইটেল নাইনে বলা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রাষ্ট্রিয় কোষাগারের টাকা নারী পুরুষ উভয়ের জন্য সমানভাবে ব্যায় করতে হবে, জেন্ডারের উপর ভিত্তি করে কারো জন্য একটাকা কমবেশি করা যাবে না। এটি শিক্ষার সকল ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করলেও সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে খেলাধুলায়।
আমেরিকানরা রাগবির মত একধরণের মারাত্মকভাবে পুরুষালি খেলা খেলে থাকে, যাকে তারা বলে আমেরিকান ফুটবল। আমাদের ফুটবলকে বলে সকার। আমেরিকান ফুটবল খুব রিস্কি, শারিরীক ঝুকি অনেক বেশি। অন্যান্য ইনজুরির পাশাপাশি, মাথায় কনকাশন রেট তীব্র। খেলাটি অনেকটাই তাদের নিজস্ব দেশীয় , আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বালাই নেই , কিন্তু তাদের নিজেদের এ খেলা নিয়ে উম্মাদনার শেষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্কুলে ভাল খেলোয়াড়দের বৃত্তি দিয়ে ভর্তি করানো হয়।
আমি পড়েছি টেক্সাস এ এন্ড এম ইউনিভার্সিটিতে। এটি ইউনিভার্সিটিগুলোর (আমেরিকান) ফুটবল র্যাংকিং এ মাঝারি দল, তবে ইউনিভার্সিটির টিমের খেলার দিনে ১লাখ ১০ হাজারি স্টেডিয়াম কানায় কানায় পূর্ণ। খেলার আগে-পরে কি উম্মাদনা! টেক্সাস এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের ((আমেরিকান) ফুটবল দলের কোচের বেতন প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট (আমাদের দেশের ভিসি) এর চেয়ে ৭/৮গুণ বেশি। বলতে চাচ্ছি, টাইটেল নাইনের আগে সরকারী খরচের বেশিরভাগ বাজেট যেত পুরুষদের এ খেলার পেছনে।
৭২ এর টাইটেল নাইন সবকিছু বদলে দেয়। আমেরিকান ফুটবল যেহেতু মেয়েরা বেশি একটা খেলতে আগ্রহী ছিল না , সে ক্ষেত্রে রাষ্ট্রিয় বাজেটের মেয়েদের অংশটুকু খরচ করার জন্য উপযুক্ত খাত বা খেলার আইটেম প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। এথলেটিক্স এর পাশাপাশি বৈশ্বিক টিমগেম হিসেবে বিকল্প হিসেবে চলে আসে সকার। বাজেটের মেয়েদের টাকা খরচ করার জন্য প্রত্যেক প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল , কলেজ, ইউনিভার্সিটির মেয়েদের সকার টিম গঠন করা হয়। ১৯৭২ এ তাদের সকারে নিবন্ধিত মেয়ে খেলোয়াড় ছিল তিন লাখের মত, ২০২০ এসে দাড়ায় ৪০ লাখের কাছাকাছি। ছেলেদের ফিফা বিশ্বকাপে ইউএস টিম মাঝে মাঝে চান্স পায় আবার পায় না। কিন্তু মেয়েদের ফিফা বিশ্বকাপে তাদের ট্রফি ধরা ছোয়ার বাইরে, র্যাংকিং এ একনাম্বার। ১৯৯১ সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ জয়ের পর আরো চ্যাম্পিয়ন হয় ১৯৯৯, ২০১৫, ২০১৯ সালে। চারবার অলিম্পিক গোল্ড মেডেল পায় আর কনকাকাফ চ্যাম্পিয়ন হয় নয়বার। বর্তমানে ইউএসএতে ফুটবল ছেলেদের খেলা আর সকার হলো মেয়েদের! এর বাইরেও অলিম্পিকের মেডাল লিস্টে বরাবর টপে ইউএসএ টপে থাকার পেছনে নারী এথলেট ও টাইটেল নাইন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
তাদের আছে ৭২ এর টাইটেল নাইন , আর আমাদের ৭২ এর সংবিধান। সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে নারী পুরুষের সকল ক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করা আছে।
এবার দরকার এর প্রয়োগ। রাষ্ট্রীয় কোষাগার হতে যে টাকা খেলাধুলার পেছনে ব্যায় করা হয় তা করা উচিত উভয়ের জন্য সমান হারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের খেলার জন্য যে বাজেট মেয়েদের জন্য চাই সমান বাজেট। মেয়েদের বাজেট দিয়ে হবে মেয়েদের প্রতিযোগিতা। স্কুল, কলেজ, বিকেএসপি সকল প্রতিষ্ঠানে ছেলে মেয়দের সমান ব্যায় করলে দেশের ক্রিড়াঙ্গনের টিমগেইম ও এথলেটিএক্সে, সবজায়গায় সুদূরপ্রসারী ছোয়া পড়তে বাধ্য।
মনে রাখতে হবে ক্রিকেট বোর্ড বা ফুটবল ফেডারেশন মূলত বেসরকারি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্টান। এগুলো মূলত তাদের আয়-ব্যায়ে চলে। এখানে জোর করেও খুব বেশি কাঠামোগত পরিবর্তন সরকারিভাবে কঠিন। কারণ যে খাতে থেকে বেশি আয় করে সেখানেই তারা খরচ করবে। তবে সরকারী সাহায্য-অনুদান যেটুকু পায় সেখানে বৈষম্যশুন্য করার সুযোগ আছে আমাদের সংবিধানেই।
৭২ এ টাইটেল নাইন চালুর পর ইউএসএ প্রথম মেয়েদের সকার বিশ্বকাপ জেতে ১৯৯১ এ। আমাদের মেয়েদের সাফ চ্যাম্পিয়ন টাইটেলে অনুপ্রানিত হয়ে আমরা যদি রাষ্ট্রীয় সুযোগগুলো মেয়েদের জন্য সমান করে দিতে পারি আমাদের মেয়েরাও এনে দিতে পারবে বৈশ্বীক সাফল্য। হোকনা সেটা ২০৪৯ এর ফিফা উইমেন বিশ্বকাপ, কিংবা তারো আগেই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন