ভালো জীবাণু খারাপ জীবাণু
জীবাণু বা অণুজীব, নাম শুনেই মনে হয় খারাপ কিছু। কিন্তু অবাক হবে জেনে, খারাপ অণুজীব বা জীবাণুর চেয়ে ভালো জীবাণুর সংখ্যাই বেশি! যার মধ্যে একটি অণুজীব আছে, যাকে তুমি প্রতিদিন সকালের নাশতায় খাচ্ছ! লিখেছেন তৌহিদ এলাহী
সুস্বাদু নরম পাউরুটি হয় ইস্ট নামের একটি ছত্রাক দিয়ে। এ ছত্রাক এক ধরনের ভালো অণুজীব।
তার মানে প্রতিদিন সকালেই কিন্তু তুমি জীবাণু খাচ্ছ।
অণুজীবের তালিকায় আছে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, শৈবাল, আরকিয়া, প্রোটোজোয়া। এদের মধ্যে বড়জোর ৫ শতাংশ দুষ্ট প্রকৃতির। অসুখবিসুখ ঘটায়। বাকিগুলো খুব দরকারি। বেশির ভাগই নিরীহ টাইপের। সাতে-পাঁচে নেই। তবে এদের খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। প্রয়োজন হয় শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্রের। এ ফাঁকে বলে রাখি, বিজ্ঞানী লিউয়েন হুক আবিষ্কার করেছিলেন এ যন্ত্র।
প্রাণিজগতের মধ্যে সবার আগে কে এসেছে পৃথিবীতে? উত্তর—অণুজীব। ডাইনোসরদেরও কোটি বছর আগে এসেছে তারা। সারা দুনিয়ায় কী পরিমাণ অণুজীব আছে তা কল্পনার বাইরে। একজন মানুষের শরীরেই থাকে ৪০ লাখ কোটি ব্যাকটেরিয়া। বাগানের এক চামচ মাটিতেই আছে ১০০ কোটি ব্যাকটেরিয়া, দেড় লাখ ছত্রাক। আসলে জীবাণুরা সব সময়ই আমাদের সঙ্গে, পাশে, ভেতরে সব জায়গায় থাকে। এমনকি আগ্নেয়গিরির জ্বলন্ত লাভায়ও এরা থাকে। তোমার-আমার মুখের ভেতর যে পরিমাণ অণুজীব আছে, তার সংখ্যা সারা দুনিয়ার মানুষের চেয়েও বেশি।
কিছু কিছু জীবাণু একা একা থাকে, যেমন অ্যামিবা। আবার কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাক দলবেঁধে থাকে। একসঙ্গে থাকলে তাদের কলোনি বলে। এরা একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। প্রকৃতিতে এদের পাওয়া গেলেও, অনেক জীবাণু কৃত্রিমভাবে পরীক্ষাগারে পেলেপুষে বড় করা যায়। ফ্রিজেও রাখা যায়।
অণুজীব কী খায়?
এদের খাবারদাবার মানুষের মতোই। মানুষের যে ধরনের খাদ্যোপাদান যেমন—শর্করা, আমিষ, ভিটামিন ইত্যাদি লাগে, জীবাণুদেরও লাগে। কিছু জীবাণু আছে, যারা বরফের মধ্যে দিব্যি বেঁচে থাকে। আর কিছু আছে, যারা ফুটন্ত পানিতেও সাঁতরায়। অনেক দিন খাবার না পেলেও হৈচৈ করে না, চুপ করে বসে থাকে। পরে আবার সুযোগ বুঝে খাবার পেলে বংশবৃদ্ধি করে। এরা বাচ্চা ফুটায় না, ডিমও দেয় না। একটি জীবাণু দুই বা চার ভাগ হয়ে নতুন জীবাণু তৈরি হয়।
দেখতে কেমন?
একেক জীবাণু দেখতে একেক রকমের। কোনো ব্যাকটেরিয়া কুণ্ডলীর মতো, কোনোটা লাঠির মতো, কোনোটা গোলগাল ফুটবল। অণুজীবদের সরাসরি অণুবীক্ষণযন্ত্রের নিচে রাখলেই দেখা যায় না, সেখানে রাখার আগে তাদের রঙের ভেতর চুবাতে হয়। একেক ধরনের ব্যাকটেরিয়াকে একেক রং লাগাতে হয়।
ছোট্ট অণুজীবের বিরাট কাজ
অ্যান্টিবায়োটিক ভ্যাক্সিন বলে যা কিছু আমরা ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করি তা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের বিভিন্ন অংশ নিয়েই বানানো হয়। আবার কিছু ওষুধ তৈরি করে ব্যাকটেরিয়া নিজেই। মানুষ শুধু সেটা সংগ্রহ করে। অনেকটা কইয়ের তেলে কই ভাজার মতো। তোমাদের বাসায় বড়দের কারো ডায়াবেটিস আছে? থাকলে দেখবে, তাঁদের কাউকে কাউকে ইনসুলিন নামের একটি ওষুধ নিতে হয় প্রতিদিন। ওই ইনসুলিন কিন্তু জীবাণু দিয়েই বানায়। এমন আরো হাজার রকম ওষুধ আসে জীবাণু থেকে।
আমাদের প্রিয় খাবার দই, চিজ, বোরহানি, মাখন, সয়াসস ইত্যাদি কিন্তু জীবাণুরা বানায়। তৈরি করা হয় নানা স্বাদের ওয়াইন, অ্যালকোহল, ভিনেগার ইত্যাদি। চকোলেট তৈরিতেও এর সাহায্য প্রয়োজন। গরু-মহিষের পেটে ব্যাকটেরিয়া না থাকলে এদের ঘাস-লতাপাতা হজম করতে বারোটা বেজে যেত। অণুজীবরা না থাকলে পৃথিবীতে পচন বলে কোনো কিছু থাকত না। পচনকারী জীবাণুরা এই মুহূর্তে কাজকর্ম বন্ধ করে দিলে সারা দুনিয়ায় মানুষের আর পুথিবীর বুকে বেশি দিন থাকা লাগবে না। এক সপ্তাহের মধ্যেই সারা দুনিয়া একটি ডাস্টবিন হয়ে যাবে।
পৃথিবীতে যত অক্সিজেন আছে তার প্রায় অর্ধেক তৈরি হয় অণুজীব বা জীবাণু দিয়ে। বাতাসে নাইট্রোজেন প্রায় ৭৮ শতাংশ। অণুজীবরা কষ্ট করে বাতাস থেকে বিভিন্ন ধরনের গাছের মাধ্যমে নাইট্রোজেন ধরে নিয়ে এসে প্রাণিকুলের জন্য উপযোগী করে। এ থেকে প্রাণীদেহে আমিষের সৃষ্টি হয়। উন্নত দেশে জীবাণু ব্যবহার করে আখ, ভুট্টা, যব ও নানা শস্য থেকে গাড়িঘোড়া, মেশিন ও কলকারখানার জ্বালানি তৈরি করা হয়। আমাদের যে তেল-গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, সেগুলোও লাখো কোটি বছর ধরে মাটির নিচের জীবাণুদের সাহায্য নিয়ে তৈরি হয়েছে।
অণুজীবরা হচ্ছে আমাদের দেহের প্রতিরক্ষা বাহিনী। এরা অনেক সময় কোনো কাজ না করে শুধু পেটের মধ্যে জায়গা দখল করে ভাব ধরে বসে থাকে। এতেই অনেকটা কাজ হয়ে যায়। অন্য খারাপ অণুজীবরা ভয়ে পেটে ঢুকতেই পারে না। দু-একটা ঢুকলেও দাঁড়িয়ে থাকার জায়গা পর্যন্ত পায় না। অনেক সময় রোগ তৈরিকারী জীবাণুদের ধ্বংস করে। আবার ব্যাসিলাস নামের একটি ব্যাকটেরিয়া আছে, যা পেটের মধ্যে থেকে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। অণুজীবরা ভালোভাবে হজম ও পেটের ভেতর ফার্মেন্টেশন না করলে আমাদের খুব বিপদে পড়তে হতো। একদম না খেয়ে থাকতে হবে। আমাদের এ সময়ে মোটা হওয়া বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে পেটের ভেতর প্রাকৃতিক অণুজীবদের বিভিন্ন অত্যাচার করে তাদের দুর্বল করে ফেলেছি।
আমাদের বিরাট গার্মেন্টশিল্পে রংচং করার জন্য বিপুল পরিমাণ এনজাইম (রাসায়নিক বস্তু) ব্যবহার করা হয়। কাপড় ধোয়ার ডিটারজেন্ট তৈরিতেও লাগে। লাগে চামড়া কারখানাসহ অনেক জায়গায়। এগুলো তৈরি করা হয় ব্যাকটেরিয়ার পেট চিপে রস বের করে। জিন প্রযুক্তির নাম শুনেছ? সেখানেও আছে অণুজীবদের খেলা। যেকোনো জীবের মধ্যে জিনগত পরিবর্তনের জন্য সাধারণত ব্যাকটেরিয়াদের ব্যবহার করা হয়। কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পরিবর্তে অণুজীবদের ব্যবহার করা হয়। প্ল্যান্টের ভেতর বায়োগ্যাস তৈরি করে আসলে কিন্তু অণুজীবরাই।
এবার বলো, জীবাণু ভালো না খারাপ? এদের ছাড়া এক মিনিটও কল্পনা করা যায়?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন