বাজেটের মূল সুর

 বাজেট  ম্যাক্রোইকোনমি ও পাব্লিক ফাইন্যান্সের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ।  অর্থনীতির গতিপথ নির্ধারক, উন্নয়নের লাইটহাউজ, দেশের আয়-ব্যায়ের গাইডলাইন।

সভ্যতার শুরু হতেই সঠিক বাজেট রাষ্ট্র বা জাতিগুলোর উন্নততর সভ্যতা তৈরিতে কাজে লেগেছে। প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে ও আয়ের উৎস খুজতে গিয়ে যুদ্ধ ও  দেশ দখল ঘটত প্রতিনিয়ত। এককালের রাজাদের যুদ্ধ আর রাজকার্য পরিচালনা সংক্রান্ত বাজেট এখন কেন্দ্রীয় সরকার ছুয়ে প্রাদেশিক কিংবা স্থানীয় সরকার পর্যন্ত গড়িয়েছে।

বাংলাদেশে প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা,  বর্তমানে তা আকারে  ৭২৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে প্রথম বাজেট ছিল জিডিপির ১৭.৪ শতাংশ আর ২০-২১ অর্থবছরের বাজেট জিডিপির ১৭.৯।  এ জায়গায় অগ্রগতি হয় নি কিছুই। ব্যায়ের জন্য দরকার আয়। বাংলাদেশে ট্যাক্স জিডিপি রেশিও যা-তা, এশিয়ার অন্য দেশ দূরের কথা, সাব-সাহারান আফ্রিকার চেয়েও অনেক কম। এ দেশে ট্যাক্সযোগ্য ৪০ লাখ খানা থাকলেও নিবন্ধন আছে ১৬ লাখ খানার,  এর মধ্যে ট্যাক্স দেয় মাত্র ৮ লাখ খানা। অতিদরিদ্র  সাব-সাহারার দেশগুলোর সরকারের রাজস্ব আয় যেখানে জিডিপির ১৮%, ভারতে ২০%,  বাংলাদেশে মাত্র ১০%। অর্থাৎ আয়ের খাত থাকলেও দেশে সঠিক পরিমাণ রাজস্ব আদায় হচ্ছে না,  যার কারণে উন্নয়নে অধিকতর গতি ব্যহত হচ্ছে।

অন্যান্য দেশের মত দেশেও বাজেট ঘাটতি থাকে,  তবে এদেশে এটি সর্বদাই সহনীয় পর্যায়ে ( ৫% এর নিচে) রাখা গেছে, বৈদেশিক ঋণ কখনোই অসহনীয় পর্যায়ে যায় নি, কিংবা মহামারী লেভেলের মুদ্রাস্ফীতির দেখা যায়নি। 

ইউরোপ আমেরিকার মত দেশগুলোকে ফলো করে বাংলাদেশ ট্রাডিশনাল ( আগের বছরের চেয়ে ৫-১০% খরচ বাড়িয়ে) বাজেটের পাশাপাশি বাংলাদেশে বাজেটে নানা কনসেপ্ট আমদানী করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- মধ্যমেয়াদী বাজেট, জেলা বাজেট, পরিবেশ বাজেট, নারী বাজেট, শিশুবাজেট। তবে এগুলো এখনো সদ্যোজাত পর্যায়ে রয়েছে, জেলা বাজেট একবারের পর আর কার্যকর করা হয় নি।

সংবিধানে বাজেটের কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে অর্থমন্ত্রীকে। অনুচ্ছেদ ৭০ ফ্লোর ক্রসিং এর মাধ্যমে নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দেয়ার সিসটেম না থাকায় অন্যান্য ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলের গণতান্ত্রিকদেশগুলোর মতই এদেশেও সাংসদরা বিপক্ষে ভোট দেয়ার সুযোগ পাবেন না। তাই এ ধরণের সংসদে বাজেট আলোচনা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। স্বাধীনতার পর থেকেই কার্যকর বিরোধীদলীয় বাধা না থাকায় তেমন কোন কার্যকর আলোচনাও হয় না। বাজেটের আগেই সরকারি দল জনমুখী আর বিরোধী দল জনবিমুখী বলে  পাল্টা-পাল্টি বিবৃত দেয়া একটা ঐতিহ্য।

এ ধরণের বাজেট ব্যবস্থায় পার্লামেন্টারি কমিটিগুলো ব্যাপক কার্যকর হওয়ার সুযোগ আছে। তবে মন্ত্রণালয় ভিত্তিক স্থায়ী কমিটি, আলাদা হিসাব ও নীরিক্ষা  সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটি, অডিটর ও কম্পট্রোলার জেনারেলের নীরিক্ষার কাজের ধরণ ও  সীমারেখা সুস্পষ্ট নয়। দেশে অডিট বিভাগের জনবল অত্যন্ত কম, অডিট সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এ সমস্যাগুলো দুর্নীতি উতসাহিত করে। তবে স্থায়ী কমিটিগুলোর কর্মপরিধি বৃদ্ধি করে হিসেব কমিটির বিলুপ্ত করলে ভাল ফল পাওয়া যেতে পারে। যেহেতু  সংসদে সাধারণ মানুষের সরাসরি কথা বলার সুযোগ নেই,  স্থায়ী কমিটি সুবিধামত বাইরের লোকজনের সাথে কথা বলে মতামত নিতে পারে।

ব্রাজিলে  সাবেক প্রেসিডেন্ট বামপন্থী লুলা সিলভার দলের স্থানীয় সরকার লেভেলের বাজেট ব্যবস্থাপনা আধুনিক বাজেটের নতুন দিগন্ত সূচনা করেছে। স্থানীয় সংঘ-সমিতির সাথে কথা বলে প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেটে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। বাংলাদেশে ট্রাডিশনাল বাজেটের পরিবর্তে জীরো বেইসড বাজেটও ভালো ফল এনে দিতে পারে। এ পদ্ধতিতে কস্ট বেনেফিট এনালাইসিস, রেট ও রিটার্ন হিসেব করে যেগুলোর প্রেডিকশন শুন্যের কাছাকাছি সেগুলোতে শুন্য বরাদ্দ যেসব প্রকল্পে প্রেডিকশন ভাল সেগুলো বেশি বরাদ্দ দেয়া যেতে পারে। পাশাপাশি সঠিক অডিট, নজরদারী, শক্তিশালী সংসদীয় জবাবদিহি দেশের বাজেট ব্যবস্থাপনা অধিকতর যুগোপযোগী করবে।

মাই নোটসঃ অর্থনীতির সক্ষমতা থাকলেও দেশের রাজস্ব আদায় অত্যন্ত কম। অর্থাৎ আয়ের পোটেনশিয়ালিটি অনেক বেশি। তাই আগামী পাচ-সাত বছর ভালো পরিকল্পনা করে ট্যাক্স জিডিপি রেশিও ১০% হতে ২০% করা জরুরি।  এজন্য এনবিআরকে আরো শক্তিশালী করা দরকার, রুট লেভেলে বিশেষ করে ট্যাক্সভ্যাট অফিস করা দরকার। ফার্স্ট থিং ফার্স্ট,  উই নিড ট্যাহা। জনবল সঠিক ভাবে ব্যবহারের জন্য  উপজেলা লেভেলে ট্যাক্স ভ্যাট এর আলাদা অফিস না করে একক অফিস করা যেতে পারে। দেশের চল্লিশ লক্ষ খানার কাছে ট্যাক্সম্যানরা পৌছাতে পারলে,  জায়গায় জায়গায় ভ্যাট মেশিন বসাতে পারলে দেশের উন্নয়ন খাতে অধিকতর বরাদ্দের জন্য ট্যাহার অভাব পড়বে না।


মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত

আধুনিক আমলাতন্ত্র: ওয়েবার থেকে ইভানস

চেপে রাখা অর্থণীতি: মুক্তবাজারের মিথ্যাবাজার

জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কথন

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

বিনির্মাণঃ ধ্বংসাত্মক সমালোচনার বৈধতা

সজল রোশানের ' রিলিজিয়াস মাইণ্ডসেট' কেমন?

ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রচিন্তা: আলথুসেরের রাষ্ট্রপাঠ