তত্বীয় অর্থনীতির সারবত্তা
তত্বীয় অর্থনীতি রসকসহীন, খটোমটো।
প্রাচীন গ্রীক সভ্যতার যুগে রাষ্ট্র চলত দান, সম্মানী, করায়ত্ত রাজ্যের খাজনা , সেবা ফি ইত্যাদির মাধ্যমে। দার্শনিক প্লেটো সম্পদ অর্জনকে হেয় চোখে দেখলেও ‘দ্যা রিপাবলিক’ গ্রন্থে শ্রমবিভাগকে আদর্শ রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তার শিষ্য এরিস্টটল ব্যক্তিগত সম্পত্তি অর্জনকে উৎসাহিত করেছেন, গোত্রগত সম্পত্তির চেয়ে একে ভাল বলেছেন। গোত্রীয় সম্পত্তির মত ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে Problems of Commons ( সবার যা, তা কেউ দেখভাল করে না) তৈরি হবে না। এযুগে সম্পদ নিয়ে কেউ খুব বেশি বাড়াবাড়ি ০করেন নাই। গ্রীক দর্শন প্রথমে অনুদিত হয় আরবীতে , পরে ল্যটিনে। এর প্রেক্ষিতেই বাইবেলে (ওল্ড টেস্টামেন ভার্সন) ও আল-কোরানে সুদকে নিষিদ্ধ করা আছে। আদতে, ইসলামী অর্থনীতি ও ব্যাংকিং গ্রীক দর্শন দ্বারা ব্যপকভাবে প্রভাবিত।
.
প্রথম আধুনিক অর্থনৈতিক তত্ব ‘Scholasticism’ বাইবেল দ্বারা প্রভাবিত। সঠিক মুল্য , যথাযথ ট্যাক্স, এবং সুদের ভয়াবহতা নিয়ে এ তত্ব আবর্তিত। এ তত্বের নিহিতার্থ-নিজেকে সংযত রেখে সঠিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা, সুদ মানুষের আত্বাকে ধ্বংস করে ইত্যাদি। থমাস একুইনাস , ফ্রান্সিসকো প্রমুখ চিন্তাবিদের মাধ্যমে ১৩শ-১৫শ শতক পর্যন্ত এ তত্বের ব্যপক প্রভাব ছিল।
.
ক্লাসিক্যাল অর্থণীতির তত্ব আসার আগে উল্লেখযোগ্য একটি ধারণা হলো Mercantilism (জার্মান ভাষায়-Cameralism)। মার্কেন্টালিজমের মূলভিত্তিঃ রাষ্ট্রের রপ্তানী বেশি- আমদানী কম, বিক্রি বেশি-ভোগ কম। বানিজ্য উদ্ধৃত্তির উপর গড়ে উঠা এ তত্বটির প্রচারক ছিলেন ব্যবসায়ী ও আমলারা, তারা যে কোন ভাবে ব্যবসায় মুনাফা বা সরকারী কোষাগার ভর্তি করতে চাইতেন। মনে করতেন, অধিকতর রপ্তানী দেশের ভেতরে উৎপাদন ও সৃষ্টিশীলতা বৃদ্ধি করে, দেশকে সমৃদ্ধশালী করে।
.
অর্থণীতি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ আইনী বিষয়, এটির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষের জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব। পাশাপাশি, সমাজের বিভিন্ন মানুষকে তার কাজের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, যারা অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় একেক জন একেক ভূমিকা পালন করে। অর্থনীতির চালিকাশক্তি হচ্ছে শ্রম দক্ষতা ও জনগণের কর্মের সৃষ্টিশীলতা । শক্তিশালী ও গভীর শ্রমবিভাগ উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে। আর, যদি পারস্পরিক নির্ভরশীল একটি বাজারব্যবস্থা থাকে তাহলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আপনা-আপনি গতিশীল থাকবে । মোট মাথাপিছু উৎপাদন একটি রাষ্ট্রের সম্পদের পরিমাণ নির্ধারণ করে, পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় এর উপর নির্ভর করে একটি প্রতিযোগিতা মূলক বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠে। ভূমি ও শ্রমের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ লাভজনক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠা সম্ভব; সামঞ্জস্যপূর্ণ মজুরি, ভূমি সংক্রান্ত ব্যয় ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে বাজারে জিনিসপত্রের দাম একটি ‘স্বাভাবিক’ পর্যায় থাকবে; এগুলি হচ্ছে ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির সারকথা। ক্লাসিক্যাল অর্থনীতির পুরোধা হচ্ছেন অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডো, সাথে নাম আসে ফ্রাঙ্কোইস কুইসনেই, জ্যা বাপটিস্ট সেই, জন স্টুয়ার্ট মিল, পিয়েরে স্রাফা- প্রমূখদের ।
.
কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলসকে বলা হয় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জনক। তাদের মতে, পুঁজিবাদীরা মুনাফার জন্য হন্যে হয়ে থাকে, ফলো তারা এমন একটি প্রক্রিয়া শুরু করে যা জন্য তারা প্রস্তুত থাকে না। পুঁজিবাদীদের অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাদের কর্মফল হিসেবে শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থার উত্থান ঘটে থাকে, মানুষের দ্বারা মানুষের নিপীড়ন বন্ধ হয়। মার্কস মনে করতেন, একটি জিনিসের দাম নির্ভর করে এর উৎপাদনে শ্রমব্যয়ের উপর। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষের শ্রমশক্তি একটি পণ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় । এছাড়াও অর্থনীতিতে ক্রাইসিস এর কারণ হিসেবে চারটি বিষয় তুলে ধরেছেন কার্ল মার্কস- এক, উৎপাদনের বিভিন্ন খাতের মধ্যে অসামঞ্জস্যতা, দুই, আয়ের অসমতা বৃদ্ধি, ফলে অর্থের অভাবে ভোগের চাহিদা কমে যাবে, তিন, মুনাফার স্বল্পতার কারণে পুঁজি কমে যাওয়া, চার, লাভ কমে গেলে বাজার থেকে টাকা তুলে নেয়া হয় হলে তারল্য সংকট তৈরি হয়; অর্থনীতি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষের সাথে পণ্যের সম্পর্ক আধা ধর্মীয় , ফলে মানুষ পণ্য, অর্থ, পুঁজিকে মহাপরাক্রমশালী মনে করে। নির্দিষ্ট পন্য ভোগ করতে না পারলে নিজের জীবন অর্থহীন মনে করে, এভাবে পণ্য ‘ফেটিশিজম’ তৈরি হয়। তারা মনে করতেন, রক্ত, ঘাম ও কান্নার উপর দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। মার্ক্স-এঙ্গেলসের বড় সমালোচনা হল তাদের তত্ত্বগুলোকে পরবর্তীতে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়-সংঘ, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে, অর্ধ-ধর্ম হিসেবে সমালোচনার উর্ধে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্ঠা করেছে। বস্তুতপক্ষে মার্ক্স-এঙ্গেলস যখন এগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন, তখনো তারা এগুলো অপরিবর্তযোগ্য ধর্মীয় বাণী হিসেবে লিপিবদ্ধ করেননি; পরবর্তীতে এগুলোকে কিভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে জানলে তারা হয়তো কষ্ট পেতেন।
.
মানুষের সফলতা সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারঃ সর্বনিম্ন খরচে সর্বোচ্চ আয় ও খরচের সর্বোচ্চ উপযোগিতা বের করে আনা। মার্জিনালিজম তত্ত্ব বলছে, মানুষ উপযোগিতা বের করে আনে ইউনিট ভিত্তিক আয়-ব্যয়- -শ্রম-উৎপাদন-ভোগের মাধ্যমে। আপনি দশ টাকার এক প্লেট ফুচকা খেয়ে যে উপযোগিতা পাবেন, পরবর্তী দশ টাকায় আরেক প্লেট ফুচকা খেয়ে তা পাবেন না। তৃতীয় প্লেটে আপনার বিরক্ত লাগবে। অর্থাৎ, আপনার আয়-ব্যয়- -শ্রম-উৎপাদন-ভোগের একটি মার্জিনাল উপযোগিতা রয়েছে। একটি নির্দিষ্ট ইউনিট পর ধীরে ধীরে এর উপযোগিতা কমে, পরে সাম্যবস্থায় চলে যায় এবং এক পর্যায়ে শেষ হয়ে যায় । মানুষের আচরণের সাথে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কটি মার্জিনালিজম তত্ত্বের সাহায্যে গভীরভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকায় তত্ত্বটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
.
এর পরের দিকে প্রচলিত ইউটিলিটারিয়ানিজম তত্ত্বটি পণ্যের সর্বোচ্চ উপযোগিতা তৈরি ও ব্যবহারকরণের মাধ্যমে সমাজ কল্যাণ নিশ্চিত করে। তত্ত্বটি সমাজ ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে। এর মূল কথা হচ্ছে, যে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সংখ্যক জনগণের সুখ ও কল্যাণ নিশ্চিত হবে, ঐ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডটি বেশি দরকারি বা সঠিক।
.
বাজার ব্যবস্থায় পারফেক্ট কম্পিটিশনের মাধ্যমে পণ্যের জোগান ও চাহিদার মধ্যে একটি সাম্যবস্থা বিরাজ করবে -এটি বাজারে কাছে প্রাথমিক চাহিদা হলেও পারফেক্ট কম্পেটিশন মোটামুটি অলীক। বরং, নানা ছুতোয় বাজারে ঢুকে পড়ে ইম-পারফেক্ট কম্পেটিশন। এ ছুতোগুলোর মধ্যে রয়েছে রয়েছে মনোপলি, অলিগোপলিসহ নানা ধরনের কার্টেল, সিন্ডিকেশন ইত্যাদি।
.
প্রতিযোগিতামূলক মার্কেটে শত্রুর অভাব নেই। শত্রু শত্রু খেলায় যারা নতুন সেবা বা পণ্য দিতে পারে, অন্ততপক্ষে , অন্য কোম্পানির নতুন পণ্য বা সেবা নকল করতে পারে তারাই মার্কেটে টিকে থাকে, বাকিরা হারিয়ে যায়। অর্থনীতিতে নতুন ধরনের গতি আসে। নতুন পণ্য , কাঁচামাল , উৎপাদন ব্যবস্থা, উদ্যোক্তা, সংগঠন , প্রতিষ্ঠান পুরনোদের শত্রু। নতুনরা পুরনোদের বাজার থেকে সরিয়ে দেয়। অর্থনৈতিক গতিবিদ্যার পরিবর্তন সংক্রান্ত এর তত্ত্বটির নাম থিওরি অফ ‘ক্রিয়েটিভ ডেস্ট্রাকশন’।
.
জন মেইনার্ড কিনস সামষ্টিক অর্থনীতির জেসাস ক্রাইস্ট। তার আগের অর্থনীতি চিন্তা এক ধরনের আর তারপরের অর্থনৈতিক চিন্তাগুলো পুরোপুরি আলাদা। সামষ্টিক অর্থনীতিতে বহুল প্রচলিত ডেফিসিট বাজেট, ব্যালেন্স বাজেট ইত্যাদি আইডিয়া কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। ঘাটতি বাজেটের উপযোগিতা দেখান, অধিকতর সরকারি খরচের উপর জোর আরোপ করেন। রিসেশন বা ডিপ্রেশন মোকাবেলায় বাজারে জোরপূর্বক অর্থের সরবরাহ ঘটানো, সোশ্যাল সেফটি নেট বা অন্য যেকোনো ভাবে মানুষের হাতে টাকা পৌঁছানো, কৃত্তিম চাহিদা তৈরি করে যোগান নিশ্চিত করে অর্থনীতি গতিশীলতা বজায় রাখার কথা বলেছেন । তিনি টাকার মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্টের কথা বলেছেন। তিনি মনে করেন, সরকারের বিনিয়োগ নানা হাতবদল হয়ে অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখে । সামষ্টিক অর্থনীতিতে কিনসিয়ানিজমের গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান ও রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন বলেছেন, we all are Keynesians now!!
.
চাহিদা অনুযায়ী যোগান থাকবে, তারপর অনন্তকাল সাম্যবস্থা বিরাজ করবে- ম্যাক্রো ইকোনমিএক্সে-এ এক অসম্ভব কল্পনা। একটি সিস্টেমে আসলে কয়টি সাম্যবস্থা? একটি বা তার অধিক? সাম্যবস্থা শুধু কি যোগানকৃত পণ্যের উপর নির্ভর করে? ওই পণ্য উৎপাদন করতে অন্য যে সকল ফ্যাক্টর জড়িত তার সবগুলোর সাম্যবস্থার উপরই কিন্তু এই সাম্যবস্থা/সাম্যবস্থাগুলো জড়িত নয়? আসলে, এখানে জড়িত ফ্যাক্টরগুলো্র সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে অসীম। সাম্যবস্থা কি স্থায়ী নাকি ক্ষণস্থায়ী? সাম্যবস্থার মাধ্যমে একটি সমাজের কল্যাণ কতটুকু নিশ্চিত হওয়া সম্ভব? আর এসবের জন্য শ্রম, ভূমি , পন্য, বাজার কিভাবে আচরণ করবে তাই সাম্যবস্থার থিউরি ও ওয়েলফেয়ার থিউরিতে আলোচিত হয়।
.
এর বাইরে সময়ে সময়ে অর্থনীতিতে আলোচিত তত্বগুলোর মধ্যে হচ্ছে গেম থিওরি, ক্যাপিটাল থিওরি, ডেভেলোপমেন্ট ইকনোমিকস, ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেট থিউরি, স্পাশাল এন্ড আরবান ইকনোমিকস ইত্যাদি ।
.
স্কলাস্টিসিজম, ক্লাসিক্যাল তত্ব, মার্কসের সমাজতন্ত্র, মার্জিনালিজম, আংশিক সাম্যবস্থা, ইউটিলিটারিয়ানিজম , কেইনসিয়ানিজম, ওয়েলফেয়ার থিউরিসহ আধুনিক তত্বগুলো তত্ত্বীয় অর্থনীতির শেষ কথা নয়। এগুলোর রয়েছে নানা ডালপালা, ভাগ-উপভাগ। নতুন তত্ত্ব পুরনো তত্ত্বগুলোকে যেমন খারিজ করেছে, আবার সামনে নতুন তত্ত্ব হাজির করার জন্য পথ তৈরি করে দিয়েছে। এভাবেই এগিয়ে চলছে তত্ত্বীয় অর্থনীতি।
Source: Economic Thought: A Brief History
By: Heinz D. Kurz
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন