উৎসবের অর্থনীতি
সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের এই মুহূর্তে নিজস্ব সংস্কৃতি হচ্ছে ভ্যালেন্টাইন ডে পালন, ইংরেজি নববর্ষ পালন, হ্যালোউইন পালন কিংবা মা দিবস/ বাবা দিবস পালন! এই দিবসগুলো পালনে সবাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েন, উইশ করেন, কে কি করছেন সবাইকে জানান, বাজি পটকা ফোটান, বেলুনে আগুন ধরিয়ে আকাশে উড়ান। এগুলো এদেশে হয় মোটামুটি বিনা বাধায়, কোন রূপ তীব্র সমালোচনা ছাড়াই।
ভ্যালেন্টাইন ডে পালন, ইংরেজি নববর্ষ পালনের উম্মাদনা রিলিজিয়াস প্র্যাকটিস লেভেলে চলে গেছে। আমি ২ বছর আমেরিকা ছিলাম। বাংলাদেশে এসব নিয়ে যতটা উন্মাদনা, সেখানে এর কানাকড়িও নেই। বিগত কয়েক বছরে জাঁকজমক হ্যালোউইন পালনে আমরা প্রায় আমেরিকাকে ধরে ফেলেছি। অন্ততপক্ষে মাতামাতির দিক দিয়ে।
ইউরোপ আমেরিকা এসব বিষয়ে আমাদের দেশে রপ্তানি করতে চেয়েছিল কিনা জানিনা, তবে সফট পাওয়ার হিসেবে এগুলো আমরা বেশ ভালোভাবেই আমদানি করেছি। আমি দেখেছি বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে যেভাবে ভ্যালেন্টাইন ডে পালন করা হয়, পহেলা বৈশাখ ধারে-পাশেও নেই। যতটুকু হয় সরকারি সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায়। মফস্বলের সবচেয়ে মহা চোর এবং ধড়িবাজটাও পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানকে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়। এবং তারা বেশ ভালোভাবে সফল হয়েছে। অন্যকিছু নিয়ে তাদের মুখে রা নেই।
কিনসিয়ান অর্থণীতির একজন নিবিড় পাঠক হিসেবে একটা জিনিস আলোচনা করি। শুধুমাত্র আমেরিকাতে ২০২১ সালে হ্যালোইন উদযাপনের অর্থনীতির পরিমাণ ১০.৬ বিলিয়ন ডলার– মানে ১০৬০ কোটি ডলার। হ্যালোইনের ভূতকে তারা কতটা পবিত্র বা ভয়ংকর মনে করে তা আমার জানা নাই, তবে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকার এ অর্থণীতিকে তারা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মনে করে। এ পরিমাণ ডলার সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়, ডলার হাত বদল হয় এবং মাল্টিপ্লায়ার ইফ্যাক্ট হিসেবে কাজ করে। এমেরিকান হ্যালোউইন ভূত আর বাংলা পহেলা বৈশাখের মুখোশের প্যাচার মিল কতটুকু তা বলা শক্ত, দুটোই কিন্তু এ দুদেশের মেইন্সট্রিম ধর্মের সাথে খুব বেশি মিল বা বেমিল কোনটাই নেই। বলতে গেলে দুটোই স্থানীয় উৎসব এবং দেশের অর্থণীতির জন্য মারাত্বক উপাদেয়।
ছোটবেলায় জামাল্পুরের গ্রামে দেখেছি কার্তিক মাসের শেষের দিন রাতের বেলায় লোকজন- বিশেষ করে বাচ্চারা এক কান্ড করত। সন্ধ্যার পরে খড়কুটোর কুন্ডলী বা কাকতাড়ুয়া বানিয়ে লাঠির মাথায় বসিয়ে আগুন ধরিয়ে দিত, এবং লাঠি হাতে নিয়ে নানা ধরনের ছড়া আওড়িয়ে দৌড়াদৌড়ি করত। আমি বড়দের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছি, তারা মনে করত কার্তিক মাস ছিল কলেরা, ওলা উঠাসহ নানা মরণঘাতী অসুখের উর্বর মাস। কলেরা বিবি, ওলা ঊঠা বিবিদের দৌড়ানি দেয়ার জন্য তাদের পাছায় আগুন ধরিয়ে এসব করা হতো। এর কাছাকাছি একটি বিষয় দেখেছি টেক্সাস এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। নভেম্বরের শেষের দিকে কাঠের লগ জোগাড় করে প্রায় ১০০ ফুটের মতো পাল্লা দেয়। তারপর ৩০ থেকে ৭০ হাজার লোকজন ঘিরে ধরে আগুন ধরিয়ে দেয় । বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষকসহ অন্যদের বিশ্বাস, সবার মধ্যে ভাতৃত্ব বন্ধন দৃঢ় হবে, তাদের পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, খেলাধুলাসহ নানা বিষয়ে সকল ধরনের অপশক্তির কুনজর কেটে যাবে। দেখেই বোঝা যায়, আসলে এসব কেউ বিশ্বাস করে না, তবে স্থানীয় কালচার হিসেবে সবাই জোরেশোরে উদযাপন করত।
এবার আসি ১৪ই এপ্রিল তথা পয়লা বৈশাখের বেলায়।
ভারতের কয়েকটি রাজ্য, মিয়ানমার, নেপাল, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া এবং ভিয়েতনামে সরাসরি ১৪ই এপ্রিলকে নববর্ষ হিসেবে উদযাপন করা হয়। আর ইরান , চায়নাসহ পৃথবীর প্রায় সকল দেশ ঐ দেশের কালচার অনুযায়ী সে দেশের নববর্ষ উদযাপন করে। সবারতো এটা ধর্মীয় উৎসব হওয়া সম্ভব না। তারপরেও চলে সারাদুনিয়ায়। মানুষের জন্য উৎসবের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের নির্ভরযোগ্য সুযোগ হচ্ছে এসব স্থানীয় উৎসবগুলো।
আকবর আলী খান কয়েকটি রেফারেন্সে দেখিয়েছেন একটি উন্নয়নশীল দেশে সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয় ধর্মসমুহের, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের। এটা মোটামুটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এমনকি দুর্ণীতি বেড়ে গেলেও ঐ এলাকায় ধর্ম-বিশ্বাসী বেড়ে যায়!!
ওয়াজিনে কেরামদের অনুরোধ আপনারা যে ফি বছর শতশত ওয়াজ মাহফিল করতে পারছেন , সোশ্যাল মিডিয়া ওয়াজিনেরা এমবি কিনে মনের আনন্দে পয়লা বৈশাখ বন্ধ করতে বলতে পারছেন , তার অন্যতম কারণ এ দেশের ম্যাক্রো-একনোমির শক্তি-সামর্থ বৃদ্ধি। মানুষ চাদা দিতে পারেন, আপনারাও এমবি কিনতে পারেন। বাংলা নববর্ষকে ঘিরে ৪০ থেকে ৪২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থনীতিক কর্মযজ্ঞ, কোরবানী ইদকে ঘিরে ৮০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা বাণিজ্য, প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার দূর্গা পুজার অর্থনীতি – এগুলো কোনটার ভূমিকাই নিতান্তই কম না। অন্যান্য দেশ যেভাবে আমাদের কাছে ভ্যালেন্টাইন ডে পালন, ইংরেজি নববর্ষ পালন, হ্যালোউইন পালন কিংবা মা দিবস/ বাবা দিবস পালন রপ্তানী করেছে, তাদের কাছে রপ্তানী করার জন্য আমাদের আছে শুধুমাত্র এই পহেলা বৈশাখ।
তাই এসব ধর্মের নামে বন্ধ করে নিজের পেটে নিজে লাথি মারবেন না। পাছে চাদা দেয়ার মানুষ আর এমবি কিনার টাকা পাবেন না। আর সারাজীব্বন অন্যেরটাই পালন করে যাবেন, নিজের বলে কিছু থাকবে না-- জাতীয় হীনমন্যতা আর ছোটলোকি থেকে বের হতে পারবেন না।
শুভ নববর্ষ।
বিদ্র: টেক্সাস এ এন্ড এম বোনফায়ারের কিছু ছবি দিলাম


মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন