মনস্তাত্ত্বিক ইউরোপের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান
ইউরোপ শুধুমাত্র কোন ভৌগোলিক অবস্থান নয়- এটি একটি মানসিক প্রবণতা, চিন্তাধারা এবং ক্ষেত্রবিশেষে চাপিয়ে দেওয়া দর্শন। ইউরোপ বা পাশ্চাত্য সারা দুনিয়াকে অস্বীকার করে নিজেদের মতো করে জ্ঞান চর্চা এবং জ্ঞান উৎপাদন করতে পারে, কিন্তু ইউরোপের বাইরের দুনিয়া ইউরোপ ছাড়া কিছুই করতে পারে না। পৃথিবীর আধুনিক জ্ঞান ভান্ডারে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি সংস্কৃত, ফারসি , আরবি ইত্যাদি ভাষায় চর্চিত জ্ঞানগুলোকে। সাবঅল্টার্ন ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তী ভৌগলিক ইউরোপ নয়, মনস্তাত্ত্বিক ইউরোপের মাতব্বরিকে প্রশ্ন করেছেন তার ‘প্রভিনশিয়ালাইজিং ইউরোপ’ বইতে। তিনি দাবি করেছেন, মনস্তাত্ত্বিক ইউরোপের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, কিন্তু এটি অপরিহার্য নয়।
দীপেশ চক্রবর্তী মনস্তাত্ত্বিক ইউরোপের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বেশ কিছু তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। ইউরোপীয় চিন্তার প্রধানতম সমালোচনা হিসেবে তিনি দাঁড় করিয়েছেন ‘ ইতিহাসের বিশ্রামাগার’ বা ওয়েটিং রুম অফ হিস্ট্রি তত্ত্বটি। ইউরোপ দাবি করে রাষ্ট্র, সভ্যতা, নাগরিকত্ব, গণতন্ত্র , সামাজিক ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা ইত্যাদি তাদের প্রোডাক্ট। সারা দুনিয়ার উচিত এসব প্রোডাক্ট গ্রহণ করা। যারা এসব প্রোডাক্ট ব্যবহার করবে না, তারা সভ্য হতে পারবেনা, আধুনিক হতে পারবেনা । দুনিয়া দুই ভাবে বিভক্তঃ এক ভাগে, যারা ইউরোপ বা পাশ্চাত্যের মতো হয়েছে, অন্য ভাগে, যাদের ইউরোপ বা পাশ্চাত্যের মতো হওয়া উচিত। ভৌগলিক ইউরোপ নিজেদের নাগরিকদের জন্য এগুলোর চর্চা সবসময়য় অবারিত করে দিয়েছে। তবে এই ইউরোপিয়ানরাই ইতিহাসের বিশেষ সময়ে সময়ে , এ ধারণার সাথে উটকো শর্ত জুড়ে দিয়েছে। বিশেষ করে ইউরোপিয়ানরা যেসকল এলাকাগুলোতে উপনিবেশ স্থাপন করেছে, ওইসব ঔপনিবেশিক এলাকায় এসব আধুনিক ধারণা চর্চার অধিকারকে অস্বীকার করা হয়েছে। তারা বলতে চেয়েছে, এই কম সভ্য জাতি গুলোকে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। উপনিবেশিকতার চর্চার মাধ্যমে ইউরোপিয়ানরা তাদেরকে মোটামুটি সভ্য- ভদ্রস্ত করতে কিছুদিন সময় লাগবে, ততদিন তারা শিখুক। আপাতত ওইসব ইউরোপিয়ান মূল্যবোধগুলো চর্চা করার দরকার নাই।
অর্থাৎ যাত্রীরা নতুন কোন ট্রেনে ওঠার আগে যেমন স্টেশনের ওয়েটিং রুমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে– তারপর নতুন ট্রেনে উঠতে পারে, তেমনি এই কম সভ্য, কম আদর্শযুক্ত জাতিগুলোকে আরো কিছুদিন ইতিহাসের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করতে হবে তাদের নিজেদের রাষ্ট্র পাবার, জাতিসত্তা গঠন করার বা অন্যান্য ইউরোপিয়ান প্রোডাক্ট গুলো ব্যবহার করার জন্য। দীপেশ চক্রবর্তী ইউরোপিয়ানদের তাদের অধীনস্থ কলোনিগুলোকে আধুনিকতার ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রাখার নামে ঔপনিবেশিক শাসনকে দীর্ঘায়িত করার পায়তারাকে বাঁকা চোখে দেখেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে আধুনিক হবার জন্য কোন বিশ্রামাগারে বসে থাকার প্রয়োজন নেই, তারা নিজেরাই নিজেদের মতো করে আধুনিক হয়ে যেতে পারে।ইউরোপিয়ান চিন্তাভাবনাই আধুনিকতার একমাত্র গন্তব্য নয়। এজন্য অ- ইউরোপীয়রা যেখানে আছে সেখান থেকেই তাৎক্ষণিকভাবেই আধুনিকতার দিকে যাত্রা করতে পারে। হয়তো সে আধুনিকতাটি ইউরোপিয়ান আধুনিকতা নয়, সেটি হবে স্থানীয় একটি অন্যরকম আধুনিকতা।
ইউরোপীয় চিন্তার প্রভাবে অ-ইউরোপীয়রাও মনস্তাত্ত্বিক ইউরোপে বাস করে। অ-ইউরোপিওরা নিজেদেরকে ইউরোপীয়দের সাথে তুলনা করে এবং নিজেদেরকে মনে করে সীমাবদ্ধ, অসম্পূর্ণ ও অবিকশিত হিসেবে। দীপেশ চক্রবর্তী অন্যদিকে না চেয়ে নিজেদের দিকে ফিরে তাকাতে বলেছেন। বলেছেন, চিন্তার আদর্শ গুলো সত্যিকার অর্থে প্রোথিত ও সম্পর্কিত হচ্ছে নির্দিষ্ট স্থানের সাথে। বাইরের জিনিসকে মহান ও শ্রেষ্ঠ মনে করে জোর করে নিজেদের ভেতর ঢোকানোর দরকার নেই। অন্য ভৌগোলিকা এলাকার চিন্তা আদর্শ থেকে উদ্ভূত প্রোডাক্টগুলো আমাদের এলাকার ইতিহাস ঐতিহ্যের সাথে খাপের খাপ মিলে যাবে এটা মনে করার কোন কারণ নেই।
দীপেশ চক্রবর্তী চিন্তার লোকেশনের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি তত্ব দিয়েছে্ন, নাম দিয়েছেন ইতিহাস ১ (এক), ইতিহাস ২ ( দুই)। ইতিহাস এক হচ্ছে পুঁজির ( মোটাদাগে পুঁজিসহ সকল পাশ্চাত্য চিন্তাভাবনা ও আধুনিকতা) সফলতার ইতিহাস, যে ইতিহাসে পুঁজি নিরবিচ্ছিন্নভাবে নিজ গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইতিহাস দুই হচ্ছে, পুঁজির ব্যর্থতার ইতিহাস, একটি নির্দিষ্ট স্থানের ইতিহাস, ঐতিহ্য , সংস্কৃতি পুঁজির অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিয়েছে, পুজিকে কম্প্রোমাইজ করতে হয়েছে, পুঁজি সবকিছুকে জয় করতে পারেনি। পুঁজিবাদ , সাম্রাজ্যবাদ , বিশ্বায়নের সাথে ভারতবর্ষের খাপ খাওয়ানোর সংগ্রামকে ইতিহাস দুই হিসেবে তুলে ধরেছেন দীপেশ চক্রবর্তী। অনেক আধুনিকতা ভারতবর্ষবাসি গ্রহণ করলেও, নিজেদের অনেক কিছুই তারা নিজেদের মতো করে পরিবর্তন করে নিয়েছে।
দীপেশ ইতিহাসের আলোকে সময়কে ভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। ইতিহাসের আলোকে সময় ধারাবাহিক বা একক কোনো ব্যাপার না। একটি নির্দিষ্ট স্থানে অতীত , বর্তমান , ভবিষ্যৎ একসাথে পাওয়া যেতে পারে। যেমন, আমরা বর্তমানে থেকেই অতীতে বাস করতে পারি। ইউরোপের আধুনিকতার কাছে যা অতীত, তা আমাদের কাছে বর্তমান বাস্তব মনে হতে পারে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট স্থানের উপর ভিত্তি করে সময় একটি জংশন, এ জংশন থেকে অতীত , বর্তমান ,ভবিষ্যৎ সবখানে যাওয়া সম্ভব। মানুষ ধারণাগত উন্নত কারো ছাঁচে ফেলে দেয়া কোন যন্ত্র বা জন্তু না, দীপেশের মতে ‘দেয়ার আর ডাইভার্স ওয়েজ অফ বিইং হিউম্যান’। আমাকে মানুষ হতে গেলেই অন্য কারো মত উন্নত মানুষ হতে হবে- এ বেশি বড্ড অপ্রয়োজনীয়। আমরা আমাদের মত করেই মানুষ হতে পারি।
একটা উদাহরণ দেয়া যাক। বর্তমান বিশ্বে মহাপ্রচলিত ধারণা হচ্ছে খুব শীঘ্রই ভারত-চীন মহাপরক্রমশালী শক্তি হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। দীপেশ এখানে প্রশ্ন করেছেন, মহাপরক্রমশালী শক্তি হতে গিয়ে ভারত চীন নতুন কি করেছে? তারা কি পৃথিবীর জন্য নতুন কোন চিন্তা বা দর্শন হাজির করতে পেরেছে, নাকি তারা আরো একটি নতুন ইউরোপ হওয়ার চেষ্টা করছে?
মনস্তাত্ত্বিক ইউরোপ হওয়ার সমস্যা বহুরূপ। যেমন এ সময়ে এসে বৃদ্ধ ইউরোপিয়ানদের শান্তির মৃত্যুর জন্য পেলিয়েটিভ কেয়ারের অংশহিসেবে ইংল্যান্ডসহ নানা দেশে স্পেশালাইজড হসপিটাল বা ‘হসপিস’ প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। ব্যক্তি স্বাধীনতা চর্চাকারী বুড়ো ইউরোপিয়ানদের বড্ড ভয়, মৃত্যুর এই অসহায় সময়ে যাতে অন্য কারো গলগ্রহ না হতে হয়। উচ্চতর বয়োবৃদ্ধ জনমিতির কারণে এই হসপিস আর্থিক খরচের অংকে এখন ইউরোপিয়ান অর্থনীতির গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লেখক ও গবেষক শাহাদুজ্জামান মনে করেন, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে হসপিস প্রতিষ্ঠা করার মত উন্নত হওয়ার জন্য ইতিহাসের ওয়েটিং রুমে বসে থাকার প্রয়োজন নেই। বরং ভারতবর্ষের মতো সামাজিক কাঠামোগুলোতে পরিবারের মধ্যে পারিবারিক পরিচর্যার মধ্যে মানুষের শান্তির মৃত্যু অনেক বেশি আকাঙ্খিত।
সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করে, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ইউরোপীয়রা নির্বিচারে প্রকৃতিকে অপব্যবহার করেছে, এবং অন্যদেরকে তাদের মত করতে উৎসাহিত করেছে। সভ্যতা ও উন্নয়নের নামে প্রকৃতি ধ্বংসের সূত্রপাত ইউরোপীয় আধুনিকতা ধারণার মতোই পুরনো। তাই সময় এসেছে সব ইউরোপীয় চিন্তাকে মহান ও অপরিহার্য না মনে করে, প্রয়োজনীয়গুলোকে অর্জন এবং অপ্রয়োজনীয়গুলোকে বর্জন করার। সময় এখন, নিজেদের জন্য স্থানীয় জ্ঞান ও চিন্তাকে পরিচর্যা করার, স্থানীয় জ্ঞান- চিন্তা- দর্শন তৈরি করা ।
** মাই নোটসঃ দীপেশ রাজ্যে প্রবেশের চমৎকার বই এটি। শাহাদুজ্জামান তার নিজের কাজকর্মের সাথে মিলিয়ে দীপেশের চিন্তাগুলোকে খুঁজে বেড়িয়েছেন।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন