প্রচলিত মিথের দার্শনিক ও সমাজ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা
রূপকথা, উপকথা, সংস্কার, কুসংস্কার, প্রাচীন গাল-গল্প, প্রচলিত ধর্মেসমূহের ভাষ্যসহ নানা বিষয় মিথের অংশ। সমাজে প্রচলিত মিথগুলো নিছক গল্প বা বিনোদনের জন্য তৈরি হয়নি। প্রত্যেকটি মিথের রয়েছে নৃতাত্ত্বিক ভাষ্য ও ব্যাখ্যা। মিথগুলোর বেড়ে ওঠা, প্রতিষ্ঠিত হওয়া , জনসমাজে প্রভাব ফেলা– মানুষের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসের মতোই জটিল ও বহুমুখী। মিথ্ মানুষের মধ্যে মানুষের অজান্তেই জন্ম নিয়েছে। মিথকে কুসংস্কার ও আদিম চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ফেলে দেয়ার জো নেই।
আধুনিক সময়ে, বিজ্ঞানের প্রভাবে মিথের গুরুত্ব অনেক অংশে হারিয়ে গিয়েছে। এ হারানো অস্তিত্বগুলো হয়তো আর কোনদিন ফিরে পাওয়া সম্ভব নয় । সময়ের প্রয়োজনে বেকন, দেকার্তে, নিউটনসহ অন্যান্য চিন্তক-বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে ১৭শ শতকের দিকে বিজ্ঞান ও মিথ আলাদা হতে থাকে। একেবারে কমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পৃথিবী নানা জায়গার নানা ধরনের অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিয়ে-শাদী হয়। এক জায়গার সাথে আরেক জায়গার বিয়ের অনুষ্ঠানের হয়তো কোন মিল নাই। পুরো বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে খুবই বিশৃংখল মনে হবে। বিজ্ঞান এবং অন্যান্য জ্ঞানচর্চাকে ব্যবহার করে এ বিশৃঙ্খল বিষয়টিকে শৃঙ্খলভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
দার্শনিক ক্লদ লেভি-স্ত্রস সমাজে প্রচলিত মিথগুলোর দার্শনিক ও সমাজ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, যেসব আদিম জনগোষ্ঠীর লিখিত কোনো ভাষা নেই, উন্নত সভ্যতা নেই , যাদের সমাজে প্রচলিত আছে নানা ধরনের মিথ – তারা আমাদের চেয়ে কোন অংশেই কম বুদ্ধিমান নয়। তারা আমাদের মতোই তীক্ষ্ণ বুদ্ধির সাহায্যে জীবন পরিচালনা করে। যেমন, এরা পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ে বিপুল জ্ঞানের অধিকারী হয়ে থাকে। ক্লদ লেভি-স্ত্রস গবেষণা করতে গিয়ে এমন একটি আদিম জনগোষ্ঠীর খোঁজ পান , যারা প্রখর সূর্যালোকের মধ্যেও সন্ধ্যাতারা দেখতে পেত– যা আমাদের মত আধুনিক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আসলে প্রাচীন মানুষ নৌযাত্রার জন্য সন্ধ্যাতারাকে ব্যবহার করার কারণে ব্যাপারটিতে অভ্যস্ত ছিল এবং দিনের বেলায় তাদের সন্ধ্যাতারা দেখতে কোন সমস্যা হতো না। এমনিভাবে মানুষের নৃতাত্ত্বিক জীবনধারাকে বিশ্লেষণ করলেও মিথগুলোর কার্যকারণ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রকৃত অর্থে, গোষ্ঠীভিত্তিক প্রাচীন সমাজগুলোর মধ্যে মিথগুলো বেড়ে উঠতে পেরেছে উর্বরভাবে। কিন্তু যখন থেকে এক গোষ্ঠীর সাথে আরেক গোষ্ঠী মিশে যাওয়া বা ওভার কমিউনিকেশন শুরু হতে থাকে , তখন থেকেই মিথগুলো মলিন হয়ে যেতে থাকে। সার্বিকভাবে, মিথগুলো মানবজাতির আভ্যন্তরীণ বৈচিত্র্যতকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
মিথলজিস্ট ক্লদ লেভি-স্ত্রস তাঁর ‘মিথ এন্ড মিনিং’ বইতে উদাহরণ সহকারে পাশ্চাত্যে প্রচলিত বিভিন্ন মিথের উৎপত্তি, বিস্তার এবং টিকে থাকা ব্যাখ্যা করেছেন। আমি সহজে বোঝার জন্য, আমাদের এ অঞ্চলে প্রচলিত কিছু মিথকে লেভি-স্ত্রস এঁর ভাষ্য অনুযায়ী ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব। মাথায় রাখতে হবে, মিথের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অন্যতম সফলতা হচ্ছে, অনেক মিথকে এখন বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে। যেগুলোকে আমরা অদ্ভুত এবং অর্থহীন হিসেবে অগ্রাহ্য করতাম, সেগুলোকে এখন গুরুত্বের সাথে দেখার সুযোগ রয়েছে।
প্রাচীন বাংলায় কলেরা, বসন্ত ছিল ভয়ংকর প্রাণঘাতী রোগ। প্রচলিত উপকথা মতে, এসব রোগের জন্য দায়ী করা হয় কলেরা বিবি, ওলা ওঠা বিবি ইত্যাদি ভয়ংকর চরিত্রদের। তারা দেখতে খুব বীভৎস, কুশ্রী। কোনো কো্নো এলাকায় এদের হাত থেকে বাঁচার জন্য পূজা দেয়া হতো– আবার কিছু এলাকায় আগুন জ্বালিয়ে গালিগালাজ করে তাড়িয়ে দেয়া হতো। বর্তমান বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে দেখলে বিষয়টি খুবই অর্থহীন মনে হবে, কিন্তু প্রাক -আধুনিক চিকিৎসা যুগে মানুষের কাছে এর চেয়ে ভালো কোন অপশন ছিল না। শুধু তাই নয়, ভালো করে খেয়াল করে দেখবেন প্রাচীন ও আদিম বাংলার মানুষরা স্থান ও সময় ভেদে কেউ সাপের পূজা করত, কেউ হাতির পূজা করত, কেউ বাঘের পূজা করত। আবার অন্য এলাকাতে মানুষ সূর্যের বা অগ্নির প্রার্থনা করত। কেউ কেউ বৃষ্টির জন্য নাচ, গান, প্রার্থনা করে বৃষ্টির দেবীর কাছে কৃষির জন্য সুবিধা আদায় করত। অর্থাৎ সব ক্ষেত্রেই স্থানীয় মানুষকে জীবন-জীবিকা, অর্থনীতির প্রয়োজনে অনেক মিথের আশ্রয় নিতে হয়েছে, এবং মিথগুলো দীর্ঘদিন টিকে গিয়েছে।
একটি মিথের সাথে ওই এলাকার অন্যান্য মিথের সম্পর্ক অত্যন্ত জোরালো হতে পারে। প্রশ্ন আসতে পারে, কলেরা বিবি, ওলা ওঠা বিবি এই চরিত্রগুলো এত শক্তিশালী নারী চরিত্র হিসেবে কিভাবে বেড়ে উঠেছে? উত্তর হিসেবে চিন্তায় আসতে পারে, এ এলাকার সনাতন ধর্মে প্রচলিত মহাপরাক্রমশালী দেবী দুর্গা বা মা কালীকে । মিথকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য কলেরা বিবি, ওলা ওঠা বিবিকে ভীষণ কুশ্রী দেখানো হয়েছে, অন্যদিকে ধন-সম্পদ, সৌন্দর্য ও সৌভাগ্যের দেবী লক্ষ্মী বা জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, প্রজ্ঞা, জ্ঞানার্জনের দেবী সরস্বতী অত্যন্ত সুশ্রী।
এক এলাকার মিথগুলো ইতিহাস , রাজনীতির বা সময়ের প্রয়োজনে অন্য এলাকায় ভিন্ন ভাবে দেখা যেতে পারে। ইসলাম ধর্মের প্রভাবে, এ এলাকায় তৎকালীন মুসলমান শ্রেণীর রুচি ও চাহিদার প্রেক্ষিতে মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণবসাহিত্যে কেন্দ্রিক মিথগুলোর সমান্তরাল পুথি সাহিত্যে কেন্দ্রিক মিথের বিকাশ ঘটেছে। এসব সাহিত্যে দেব-দেবতার চরিত্রের মত বীরত্বব্যাঞ্জনা দিতে গিয়ে আমির হামজা, মোহাম্মদ হানিফা ইত্যাদি চরিত্র তৈরি করে তাদের অহেতুক সেক্সি ও যুদ্ধবীর হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, ইতিহাসের সাথে যার কোন সংশ্রব নেই। মিথগুলোকে তাদের গড়ে ওঠার সময়ের সাথে মিলিয়ে বিশ্লেষণ করলে ওই সময়ের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়।
মিথের সর্বশ্রেষ্ঠ সাফল্য হচ্ছে এক সময় মিথ নিজেই ইতিহাস হয়ে উঠে । সেমেটিক ধর্মগুলোর উদাহরণ টেনে ক্লদ লেভি-স্ত্রস বলতে চেয়েছেন, আদতে এ সকল ধর্মের ধর্মগ্রন্থ সমূহের নানা চ্যাপ্টার ছাড়া -ছাড়া ভাসা-ভাসা গল্প হিসেবে বিচ্ছিন্নভাবে তৎকালীন সমাজে দীর্ঘদীন প্রচলিত ছিল। পরে জ্ঞানী- দার্শনিক- বুদ্ধিমান ব্যক্তিবর্গ এগুলোর ধারাবাহিক চেহারা দিয়েছেন।
সংগীতের সাথে মিথের সম্পর্ক বেশ সারপ্রাইজিং। সংগীতের স্বরলিপি যেমন পরম্পরা ধরে এগিয়ে যায়, মিথকে তেমনভাবে ধারাবাহিক হিসেবে বোঝা সম্ভব । মিথকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে না দেখে একটি গানের মতো সমগ্র হিসেবে দেখতে হবে। মিথের অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝতে গেলে ঘটনা-গুচ্ছ কে অনুসরণ করতে হবে সামগ্রিকভাবে। আমাদের দেশের অনেকগুলো উপকথার প্লট হচ্ছে এমন: কোন এক রূপবতী রাজকন্যা দৈব বিপাকে উচ্চ অবস্থা থেকে নিম্ন অবস্থায় পতিত হয়। তারপর শক্তিশালী কোন চরিত্র এসে তাকে উদ্ধার করে। ফিরিয়ে দেয় তার উচ্চাবস্থা। এই যে উত্থিত অবস্থা থেকে পতন, পতন থেকে উত্থান সঙ্গীতের স্বরলিপির মধ্যে সম্পূর্ণরূপে নানা আঙ্গিকে দেখা যায়। সংগীতের শুরুর সাথে শেষের সমন্বয় না হলে যেমন একটি ভালো গান হয় না, তেমনি মিথের শুরুর পরম্পরার সাথে শেষটুকুর সঠিক মেলবন্ধন না হলে কালোত্তীর্ণ মিথ হিসেবে পরিচিত হয় না। পৃথিবীর বহু সংগীতের প্লট এবং কাঠামো মিথ্ থেকে ধার নেয়া হয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, সমাজের গড়ে ওঠা ও অগ্রগতিতে মিথের ভূমিকা অনস্বীকার্য। অক্ষরহীন, লিখিত ভাষাহীন সমাজে মুখে মুখে প্রচলিত মিথগুলো মানুষকে সমাজের ভেতরে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। মানুষের মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার ইতিহাসকে মিথ্ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই।
মানব ইতিহাস মিথের বাহক।

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন