ইনফেকশন: এভয়েড দ্যা আনহ্যাপি এন্ড আনলাকি
কেইস-১:
ড্যান্সার ও পারফর্মার হিসেবে সফল হবার জন্য ১৮৪০ সালে ২২ বছর বয়সে মেরি গিলবারট আয়ারল্যান্ড থেকে প্যারিসে চলে আসে এবং লোলা মন্তেস নাম ধারণ করে। নাচের জগতে সফল না হতে পেরে আদিম পেশা শুরু করে। ভীষণ সুন্দরী হওয়ার সুবাদে বারবনিতা হিসেবে দ্রুত নাম কামায়।খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায় শুধুমাত্র আলেকজান্ডার ডু যারিয়া প্যারিসে লোলার নাচের ক্যারিয়ারকে নতুন জীবন দান করতে পারে। আলেকজান্ডার ছিল ফ্রান্সের বড় পত্রিকার মালিক, ধনী ও শিল্প সাহিত্য বিশেষজ্ঞ। লোলা তাকে টার্গেট করে। তথ্য পায়, আলেকজান্ডার সকালে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে বের হয়। লোলাও ভীষণ ভালো হর্স রাইডার । একদিন ইচ্ছে করে দুর্ঘটনার ভান করে আলেকজান্ডারের ঘোড়ার উপর পড়ে যায়। এরপর প্রতিদিন তারা একসাথে ঘোড়া নিয়ে বের হত, এক মাসের মধ্যেই লোলা আলেকজান্ডারের ফ্ল্যাটে থাকা শুরু করে। আলেকজান্ডার গভীর প্রেমে পড়তে থাকে, বিয়ের কথা ভাবতে থাকে। প্রেমিকের প্রভাবে লোলার নাচের ক্যারিয়ার উজ্জ্বল হতে থাকে। তবে সমস্যা হলো--লোলা ১৯ বছর বয়সেই পালিয়ে বিয়ে করে ডিভোর্স ছাড়াই প্যারিসে চলে এসেছিল।
হঠাৎ আলেকজান্ডারের ব্যবসা এবং এবং সামাজিক প্রভাব কমতে থাকে। মেজাজ খটোমটো থাকায় মাঝেমধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। লোলার সাথে ঝগড়া অবস্থায় এক পার্টিতে গিয়ে অতিরিক্ত মদ খেয়ে আলেকজান্ডার বিউভ্যালন নামে একজন বিত্তশালী ও প্রভাবশালীর সাথে বাক-বিতন্ডায় জড়িয়ে যায়। পরদিন সকালে বিউভ্যলান তাকে পিস্তল ডুয়েলে আমন্ত্রণ জানায়, সে সময়ের প্রতিশ্রুতিশীল যুবক আলেকজান্ডার সে ডুয়েলে মারা যায়।
১৮৪৬ সালে লোলা মিউনিখে চলে আসে এবং বাভারিয়ার রাজা লুডভিগকে টার্গেট করে। লূডভিগের সহচর বন্ধু কাউন্ট রেঁচবার্গকে সে একইভাবে ঘোড়ার এক্সিডেন্টে খুজে নেয় এবং হিপ্নোটাইজ করে ফেলে। রেঁঁচবার্গ তাকে লুডভিগের দরবারে নিয়ে যায়, নাটুকে লোলা দরবারের দরজায় ঢুকার সময় সেন্ট্রির তরবারির সাথে খোচা লাগিয়ে নিজের বুকের জামা ছিড়ে ফেলে। উম্মুক্ত লোলার সৌন্দর্যে রাজার মাথা খারাপ হয়ে যায়। কিপ্টে লুডভিগ দেদারসে লোলার পিছনে খরচ করতে থাকে, লাক্সারি এপার্টমেন্ট, জামা-গয়না যা লাগে সব দিতে থাকে। সে হয়ে যায় রাজার প্রিয়পাত্রী।রাজা লোলার জন্য কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে কবিতা লেখা শুরু করে। লোলাও তার হুশজ্ঞান হারিয়ে ফেলতে থাকে। সে রাজকার্যে হস্তক্ষেপ করে, মন্ত্রী- রাজন্য, গুণীজন সবার সাথে দুর্ব্যবহার শুরু করে। সবাই রাজার উপর ক্ষেপে যায়। পক্ষ ত্যাগ করে বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়। শান্তির রাজ্যে সিভিল ওয়্যার শুরু হয়, ১৮৪৮ সালে লুডভিগ বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষমতাচ্যুত হন।
লোলা এবার ইংল্যান্ডে আসে। প্রভাবশালী ব্যারিস্টারপুত্র ও আর্মি অফিসার জর্জ হিল্ড লোলার চেয়ে ১০ বছরের ছোট। জর্জ লোলার খপ্পরে পড়ে। তাদের বিয়ে হয়। লোলার আগের বিয়ের খবর জানাজানি হলে (যেটি ডিভোর্স হয় নি) ও বাইগেমির চার্জে অভিযুক্ত হলে দুজনে পালিয়ে স্পেনে চলে যায়। এখানে এসে তাদের ঝগড়া হয়, লোলা জর্জকে ছুরিকাঘাত করে এবং তাড়িয়ে দেয়। পরে জর্জ ইংল্যান্ড ফিরে আসলেও সমাজচ্যুত হয়। অপমানে পর্তুগাল চলে যায় এবং দরিদ্র জীবন যাপন করে। অল্পদিনের মধ্যেই এক নৌ-দুর্ঘটনায় মারা যায় জর্জ।
কয়েকবছর পর অতি উতসাহী এক প্রকাশক লোলার আত্বজীবনী ছাপায় এবং কিছুদিন পর সেও দেউলিয়া হয়ে যায়।
১৯৫৩ সালে লোলা ক্যালিফোর্নিয়া গিয়ে প্যাট হাল নামে এক ব্যক্তিকে বিয়ে করে। সম্পর্ক সবসময়ের মত খারাপ ছিল। লোলা তাকে ছেড়ে আরেকজনকে বিয়ে করে। হাল অল্প বয়সে মারাত্মকভাবে ডিপ্রেসড হয়ে বিয়ের চার বছরের মাথায় মারা যায়।
৪১ বছর বয়সে লোলা সব ছেড়েছুড়ে ধার্মিক হয়ে যায়, মিশনারী ও চার্চের লোকদের সাথে সারা আমেরিকায় ঘুরে ধর্ম প্রচার শুরু করে। ভাল হয়ে যাবার দু বছর পর লোলা মারা যায়।
কেইস-২:
লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির লেখা গল্প হতে জানা যায়, এক টসটসে গোলাপী কাঠবাদাম দুর্ভাগ্যের ফেরে পড়ে খাবার হিসেবে কাকের ঠোটে আটকা পড়ে। কাক একটি দেয়ালের উপর বসে। কাঠবাদাম বিপদ বুঝতে পেরে নানা কাকুতিমিনতি করে কাকের কাছ থেকে বাচার জন্য দেয়ালের কাছে আশ্রয় চায়। দেয়ালের মায়া হয়। চিপা গর্তে কাঠ বাদামকে লুকিয়ে ফেলে। এরপর আস্তে আস্তে কাঠবাদাম অংকুরিত হয়, শেকড় ও ডালপালা গজিয়ে বড় বৃক্ষে পরিণত হয়। দেয়াল ফেটে চৌচির হয়ে ভেংগে যায়, লোকজন ইট চুন শুড়কি খুলে নিয়ে যায়।
কেইস ৩:
ক্যাসিয়াসের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল তীব্র হিংসা। জুলিয়াস সিজার বা অন্য যে কেউ তার চেয়ে বেশি ট্যালেন্টেড এটা সে মানতে পারত না। সিজার এটা বুঝতে পেরে সেনাপতির দায়িত্ব ক্যাসিয়াসকে না দিয়ে ব্রুটাসকে দেন। ব্রুটাস সিজারের ডিক্টেটরশিপ পছন্দ করত না। তবে অপেক্ষা করলে সিজারের মৃত্যুর পর সেই হয়ত সিংহাসনে বসতে পারত। কিন্তু ক্যাসিয়াস প্রতিদিন নিন্দা-গল্প-আলাপ, সময় দেয়ার মাধ্যমে ব্রুটাসের মনে সিজারের প্রতি ঘৃণার বীজ ছড়িয়ে দেয়। একসাথে ষড়যন্ত্র করে। ব্রুটাস ক্যাসিয়াকে ইনফেকট করে সিজার হত্যার মাধ্যমে ইতিহাসের অন্যতম ট্রাজেডির জন্ম দেয়।
ব্যাখ্যা:
সৌন্দর্য ও সেক্স আপিলের বাইরে লোলার রহস্য আলাদা। সে তার সম্মোহনী চরিত্রের কারণে তার প্রেমিকদের মুগ্ধ করে ফেলে। তারা ঘুর্নিতে পতিত হয়ে বলহীন ও হতবুদ্ধি হয়ে যায়। লোলার আকর্ষণ তাদের জীবনের একমাত্র অবলম্বন হয়ে যায়। এ পর্যায়ে এসে আসল খেলা শুরু হয়। লোলার ইনহেরেন্ট ভীতরকার অস্থিরতা কাউকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। ঝগড়া শুরু হয়। সবাই লোলার সমস্যার সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। ইচ্ছে করলেও আর বের হতে পারে না। এ সমস্যা, ঝগড়া, অস্থিরতার ইনফেকশন ঘরে বাইরে ছড়িয়ে যায়, সকলেই ইনফেক্টেড হয়। সমাধান কি তাকে ছুড়ে ফেলে দেয়া?
তবে এ ইনফেকশন মেয়েলী কোন ব্যাপার না। এটা নারী পুরুষ সকলের।এ ইনফেকশন ভেতরের অস্থিরতা বাইরে ছড়িয়ে দেয় এবং সকল শান্তি-সৌম্যকে লন্ডভন্ড করে দেয়। ব্যক্তি হিসেবে আপনি যদি এমন কোন ইনফেকটরকে খোজে পান, আগে পালান। আর্গু করার দরকার নাই, হেল্প করার দরকার নাই। এমনকি এসকল লোককে আপনার কোন বন্ধু বা কাছের লোকের কাছেও গছিয়ে দেবেন না।
পালান নইলে মরেন।
মনোবিশ্লেষণ:
মানুষ বিপদে পড়বে। ভালোমানুষ হিসেবে তাদের সাহায্য করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু কিছু মানুষ অনেক ভালোভাবে চলার সুযোগ-সুবিধা থাকার পরেও ভুতের কিলে বার বার নিজেদের উপর বিপদ ডেকে আনে। এখানেই মূল বিষয় লুকিয়ে।
আপনি ড্যজলিং ক্যারেকটারের মানুষদের অল্পদেখে নাও চিনতে পারেন। কিন্তু মানুষের প্যাটার্ন খুজে দেখলে আসল তথ্য পাবেন। সে একই ভুল ধারাবাহিকভাবে করে। নিজের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, নিজেরা হোক না হোক, আবশ্যিকভাবে অন্যদের জন্য বারবার দুর্দশা বয়ে আনে। এই প্যাটার্ন আপনাকে ধোকা দিতে পারবে না। আপনার মনে হবে এধরণের লোকদের আপনি মায়ায় জড়িয়ে ঠিক করে ফেলবেন, কিন্তু ভুল। কারণ, মানুষ মুড ও ইমোশনে মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হয়। যাদের সাথে আপনি সময় কাটান তাদের চিন্তার পথ আপনাকে প্রভাবিত করবে ভীষণভাবে।
সে পরিবর্তন হবে না, আপনি ডুবে যাবেন।
চিরন্তন অসুখী অস্থির মানুষগূলো এ ক্ষেত্রে দুকাঠি এগিয়ে। তাদের ইমোশন আর এক্সপ্রেশন হয় মারাত্বক তীব্র। নিজেরা নিজের দুর্দশা ডেকে এনেছে এটা আপনি প্রথমে নাও বুঝতে পারেন। এরা যে কারণ বা ব্যাখ্যা দেবে --সেটা না দেখে কি ক্ষতি করে সেটা লক্ষ্য করুন। তারা নিজেদের উপর কি ধরণের বিপদ ডেকে এনেছে, তাদের ঘোলাটে অতীত, মানুষের সাথে অহরহ সম্পর্কের ভাঙাগড়া, অস্থির ক্যারিয়ার ইত্যাদি স্টাডি করুন। এতকিছুর পরেও অবশ্যই তাদের চরিত্রে আকর্ষণ করার মত কিছু বৈশিষ্ট্য পাবেন যেগুলো আপনার স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধিকে নষ্ট করে দিতে পারে। তাদের চোখে তাকান, অতৃপ্তির ছায়া দেখবেন সর্বদাই।
ইনফেকশাস লোকজন ভিক্টিম কার্ড খেলতে মারাত্বক উস্তাদ। এমনকি আপনি বুঝতে পারলেও এদের থেকে পালানোর জন্য অনেক সময় ও শক্তি ব্যয় করতে হবে। তাই যখন বুঝবেন, কোনদিকে না তাকিয়ে ইন্সট্যান্টলি ভো-দৌড় দেন। প্লিজ পালান।
ইনফেশনের ভাল সমাধান কোয়ারান্টাইন এবং আইসোলেশন।
পজিটিভ টেক :
মানুষের ইমোশনগুলো অসমোসিস প্রক্রিয়া মেনে চলে। তাদের সরলতা, বিনয়, আত্ববিশ্বাস, পরিশ্রম, সফলতা দেখে দেখে এগুলো নিজের ভেতর খুজে পাওয়া শুরু করবেন। তাদের তৃপ্তির হাসি, সুখের ছায়া, সাফল্যের আকাঙ্ক্ষা, সব কিছুকে পজিটিভলি দেখার মোটিভেশন আপনাকে ইম্ফেকট করবে। যদি উদ্ধত হন, বিনয়ীদের কাছে থাকুন, মনখারাপ হলে হাসিখুশি মানুষের সংগ লাভ করুণ, জ্ঞান পিপাসা থাকলে জ্ঞানী মানুষের সান্নিধ্যে আসুন। আপনার দোষগুলো অন্যদের মধ্যে থাকলে তাদেরকে এডিয়ে চলুন।
ভালো মানুষের ভালো বৈশিষ্ট্যগুলোতে যেচে গিয়ে সংক্রমিত হোন।
'DO NoT DIE OF Another's MISERY."-- Baltasar Gracian.
Source: 48 Laws of Power, Robert Greene
Law Number 10---Infection: Avoid the Unhappy and Unlucky
ইনফেকশন: এভয়েড দ্যা আনহ্যাপি এন্ড আনলাকি
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন