হিংসা ব্যবস্থাপনা
প্রতিবার আমার কোন বন্ধু সফল হয়, আর আমি অল্প একটু করে মরে যাই- গোর ভিদাল
মানুষের সকল আবেগের মধ্যে হিংসা অত্যন্ত জটিল ও আজব। কমবেশি, সকল মানুষের মধ্যে হিংসা সক্রিয়। আমার চেয়ে অন্যের বিষয়সম্পত্তি, পাব্লিক এটেনশন, সম্মান , মেধা , যোগ্যতা , ক্ষমতা বেশি আছে - অন্যের চেয়ে আমি ছোট- এ অনুভূতি এক অসহ্য বেদনা। হিংসাই মূলত আদি পাপ। ইসলাম ধর্মে বর্ণিত হাবিল কাবিলের মারামারি, ওল্ড টেস্টামেনের আবেলেকে কেইনের হ/ত্যা ইত্যাদি হিংসা থেকে উদ্ভুত। এযুগে হিংসা উঠলেই তো আর মে/রে ফেলা যায় না, কিন্তু বাকি যা করা যায় হিংসুটে ব্যক্তি তার সবটাই করে।
আমি কাউকে হিংসা করছি, এটি সবার আগে গোপন করি নিজের কাছে। বিষয়সম্পত্তি, পাব্লিক এটেনশন, সম্মান , ক্ষমতা অন্যের বেশি আছে- এটাকে জাস্টিফাই করি অন্যায়, দুর্ভাগ্য, অসাম্য হিসেবে। যে পেয়েছে তাকে ভাগ্যবান, উচ্চাভিলাষী , অসত হিসেবে ট্যাগ দিয়ে দেই। হিংসুটেরা অন্যের অর্জন ধ্বংস করে, সম্মানহানি করে, বদনাম করে, সম্পর্ক নষ্ঠ করে। কিন্তু ভাবখানা এমন করে-হিংসা বলে কিছু নেই, যা করা হচ্ছে তা যথাযথ; অসমতা ও অসচ্ছতার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ।
হিংসা দু প্রকার : প্যাসিভ হিংসা- কারো সফলতায় বা ভালো কিছুতে খারাপ লাগা কাজ করে, কিন্তু এ পর্যায়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় না, দু একটা বাকা-ত্যাড়া কমেন্ট , একটু হাল্কা নিচে নামানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। একটিভ হিংসা- অন্যের সুপিরিয়রটির যন্ত্রণা খুব বেশি গভীর হলে , হিংসার বশে ক্ষতি করতে পদক্ষেপ নেয়া হয়। ক্ষতি করাটা আনন্দের, তবে এ অনন্দ ক্ষণিকের। কেননা, হিংসুটে ব্যক্তি সর্বদাই নতুন টার্গেটের সন্ধানে থাকে। চারপাশে অনেকেই প্যাসিভ হিংসা পুষে বসে থাকতে পারে। যদি সচেতন না হই, যে কোন মুহুর্তে এক্টিভ হিংসার রুপ নিয়ে আমাদের ক্ষতি করবে।
মানব মনের নিবিড় পাঠক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব অন্যের ও নিজের হিংসার কারণ ও সমাধান খুজে বের করা। হিংসুটে ব্যক্তিরা ক্ষতি করার আগেই আমাদের তিনটি বিষয়ে নজর দিতে হবে: হিংসার গোপন চিহ্নগুলো কেমন, হিংসুটে ব্যাক্তিরা কেমন হয়, কি কি কাজ ও পরিস্থিতির জন্য হিংসার টার্গেটে পড়তে পারেন।
.
হিংসার চিহ্ন ( Signs of Envy):
হঠাত একটা বিচ্ছিন্ন বৈশিষ্ঠ্য দেখে এটাকে অত পাত্তা দেয়ার কিছু নেই, প্যাসিভ হিংসা হিসেবে ধরে নিয়ে মাফ করে দেন।যেসব শক্ত সমালোচনার সাথে আসলে আপনার কার্যকলাপের তেমন সম্পর্ক নেই, সেগুলো হিংসার চিহ্ন। আপনাকে বিব্রত করবে কিন্তু এটা হিংসা না যৌক্তিক, সেটাও বোঝানোর চেষ্ঠা থাকবে। নিচের সাইনগুলোর কম্বিনেশন ও রিপিটেশন হলে এলার্ট মুডে চলে যান।
১.মাইক্রোএক্সপ্রেশন্ ( Microexpressions): ফার্স্ট এক্সপ্রেশন গুরুত্বপূর্ণ , প্রায় পুরোটাই একিউরেট। পরের দিকে হিংসার সাইন লুকিয়ে ফেলা সম্ভব হলেও শুরুতে এই ম্যাকানিজম থাকে না। হিংসার দরজা চোখ। চোখের দিকে তাকান, দেখবেন চোখ দিয়ে আপনাকে গর্ত করে দিচ্ছে, ঘৃণা ও শত্রুতা ভেসে আসছে চোখের দৃষ্টিতে। তবে এটা অল্প একদুই সেকেন্ড সময়ের জন্য। এরপর মাথা নিচু হিয়ে যাবে, নাকের উপর উপরের দিকে কুচকে যাবে, চিবুক বাইরের দিকে ঠেলা দেবে। চোখ জ্বলজল করবে। এরপর একটা ফেইক স্মাইল পাবেন। হিংসা ধরার একটা পদ্ধতি ( Schadenfreude) বাতলে দিয়েছেন দার্শনিক শোফেনআওয়ার। যিনি আপনাকে হিংসা করছে বলে সন্দেহ করছেন, তাকে আপনার যে কোন ভাল খবর যেমন প্রমোশন, নতুন চাকুরি , প্রেম বিয়ে ইত্যাদি বলুন। তাদের মধ্যে ক্ষণিকের মধ্যে হতাশার দেখবেন। আপনার কোন খারাপ খবর জানান , তাদের চোখমুখ আনন্দে ভরে উঠবে।
২.বিষাক্ত প্রশংসা: চাকরি যেটা পেলেন, সেখানে খালি উপরি আর উপরি ইনকাম। ফ্যান ফলোয়ার অনেক -তবে বেশিরভাগ ফানি/ ইন্টারেস্টিং( আসলে মিন করছে চিপ/মুর্খ)। আবার যে জিনিস হারিয়ে ফেলেছেন তার পূজা করে দেবে- আপনার এক্স গার্ল্ফ্রেন্ড তামান্না ভাটিয়া, আগের অফিস ছিল অস্টম স্বর্গ। এগুলো সংবাদ শোনার সাথে স্পন্টেনেয়াসলি করবে। এই সাইনগুলো রিপিটেশন দেখলে প্লিজ বি এলার্ট।
৩.ব্যাকবাইটিং- কলিগ ফ্রেন্ডদের মধ্যে অনেককে পাবেন গসিপিং এ উস্তাদ। এরা গসিপ করে সেক্সুয়াল প্লেজার পায়। গসিপ করার সময় ইনটেন্স অর্গাজমের মত চোখ মুখ খুসিতে ভরে উঠে। তাদের দৃষ্টিতে কেউ ভাল না, সবাই আলগা ভাব ও ভং ধরে থাকে। সাবধান। এই লোক ভবিষ্যতে আপনাকেও মেরে দেবে। সমস্যা হলো সবাই জানে সে আপনার কাছের লোক, তার কথা বিশ্বাস করে বাইরের লোকজন আপনাকে খারাপ জানবে। এমন প্রবলেমে একবার পড়লেই তাকে সারাজীবনের জন্য আল্লাহ হাফেজ।
৪.দ্যা পুশ এন্ড পুল: এরা আপনার ক্লোজ বন্ধু হওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাবে। এরপর আপনার দুর্বল জায়গা খুজে বের করবে। এরা হচ্ছে বিপক্ষের আইনজীবীর মত, যেই দুর্বলতা কাল্পনিক সেটাকেও আপনার প্রধান সমস্যা হিসেবে ধরে তুলে ধরবে। তাদের কিছু বলতে যাবেন, আপনাকে আরো খারাপ বানিয়ে ছাড়বে। এদের আগের সম্পর্কগুলোও এভাবেই নষ্ঠ হয়েছে। এদের সবচেয়ে বড় সাইন হলো, এরা বন্ধু বানাবেই এমন কাউকে যাদের কোন কোয়ালিটির জন্য হিংসা করা যাবে এবং পরে সুক্ষ্ণভাবে টর্চার করা যাবে।
.
হিংসাকারীর প্রকারভেদ: সাইকোএনালিস্ট মেলানি ক্লেইন দাবী করেছেন, হিংসা হিংসুটে ব্যক্তির শিশুকাল হতেই প্রোথিত হতে থাকে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে-মায়ের নিকট থেকে খাবার বা এটেনশন পাওয়ার জন্য পিতা , অন্যান্য ভাই-বোনদের সাথে কমপিটিশন। একদম ছোটবেলায় পিতামাতার প্রিয় সন্তান হিসেবে কাউকে বেছে নেয়া ও অন্য সন্তানদের সামনে প্রকাশ করা ধ্বংসাত্মক। এসব শিশুরা বড় হয়ে নিজেদের সর্বদাই বঞ্চিত মনে করে ও অতৃপ্ত থাকে। অন্যের কি আছে , নিজের কি নাই এটা তাদের তাড়া করে বেড়াবে।
বড় হওয়ার সাথে পরিবার, বন্ধু, প্রেমিক/কা, শিক্ষক অন্যান্যজন থেকে ভালোবাসা পেয়ে আমরা তৃপ্ত ও কৃতজ্ঞ হতে শিখি। হিংসুটে ব্যক্তিরা এই স্বাদের এক্সপোজার পায় না। হিংসা খুব পেইনফুল অনুভূতি, এ অনুভুতি হ্রাস করার জন্য তারা সর্বদাই ক্ষতিকর কাজ করবে। মনস্তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে হিংসুটে প্রধানত ৫ প্রকার।
১.দ্যা লেভেলার: এই ধরণের লোক শুরুতে বেশ মজার, সেন্স অফ হিউমার ভাল। দুনিয়ার অন্যায় অবিচার নিয়ে সর্বদাই সোচ্চার। দুর্বলের জন্য উচ্চকন্ঠ। তবে তার চেয়ে ভাল কেউ হলে বা থাকলে তাদের ব্যাপারে খড়্গহস্ত। যারা ভাল কিছু হয়েছে বা করেছে তারা সিস্টেমকে মেনিপিউলেট করেছে, ভাগ্যের জোরে পেয়েছে, তাকে প্রশংসা করার কিছু নেই। তারা যে কোন সফলতাকে অন্যায়ের সাথে রিলেট করে দেয়। অন্যের ব্যাপারে নানা কিছু বললেও নিজের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলার সুযোগ দেবে না। তারা শুধু নিজের প্রতি হওয়া অন্যায় অবিচারের গল্প বলতে ভালোবাসে। নিজেরা ধোয়া তুলসীপাতা। তাদের প্রধান লক্ষ্য সকল এচিভার , পাওয়ারফুল, যারা ভাল সময় কাটাচ্ছে, ভাল আছে , যারা মহত বা বড় উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে-তাদের সকলকে মিডিওকর লেভেলে নামিয়ে আনা। একই কর্মপরিধিতে এরা বিপদজনক। আপনার কর্মস্পৃহা , পরিশ্রমের জন্য আপনাকে গিল্টি ফিল দেবে, উচ্চাভিলাষী হিসেবে ট্যাগ দেবে। আপনি সফল হলে উর্ধতন দুষ্ট লোকদের চ্যালা হিসেবে চালিয়ে দেবে।
এই ধরনের লোক প্রফেশনাল ক্রিটিক হিসেবে ভাল করে মাঝেমাঝেই। অন্যের ক্ষতি করার জন্য কারো কারো দ্বারা রিওয়ার্ডেড হতে পারে।
২.দ্যা সেলফ এন্টাইটল্ড স্ল্যাকার (উচ্চধারণাপোষণকারী অলস): এরা মূলত নার্সিসিস্ট অলস ও ইন্ডিসিপ্লিন্ড। এরা আজব কারণে মনে করে তাদের যে ইউনিক' আইডিয়া বা প্ল্যান' আছে তার কারণে অটোমেটিক বিরাট সাফল্য ও এটেনশন এসে ধরা দেবে। এরা অন্যের কাজের ক্রেডিট নিতে দ্বিধা বোধ করে না। কর্মক্ষেত্রে কাজের চেয়ে ব্যক্তিগত চার্ম, পলিটিক্যাল আচরণের উপর জোর দিয়ে ফায়দা নিতে চায়। যারা পরিশ্রম করে যোগ্যতার বলে ফল পায় , তারদেরকে এই পলিটিকাল অলসরা ঘৃণা করে। এরা কোন হিন্টস বা সন্দেহ করার সুযোগ না দিয়েই আপনার বদনাম ও ক্ষতি করবে।
৩.দ্যা স্ট্যাটাস ফ্রেন্ড : কেমন রোজগার, বাসা কেমন , স্পাউস কেমন আকর্ষণীয় , সন্তানরা কে কেমন করছে, কোন ক্লাসে ভ্রমণ করেন?- ইত্যাদি হবে তাদের কিউরিওসিটি। এরা যদি আপনার কলিগ হয় , একদম কান খাড়া করে থাকবে আপনি তার চেয়ে বেশি কি কি সুবিধা পাচ্ছেন। গোপনে আপনাকে আক্রমন করে আপনার অবস্থান দুর্বল করবে। আপনি কি করেন, চড়েন , কাপড় পড়েন এসব নিয়ে তাদের মধ্যে চাইল্ডিশ আগ্রহ পাবেন এবং নেতিবাচক/ হতাশ মন্তব্য পাবেন। আপনার বিপরীতে সে নিজেকে আদর্শবাদী, সন্যাসী হিসেবে তুলে ধরার অপচেষ্ঠা করবে, তবে ভিতরে উল্টা। এসব মানুষের সাামনে নিজের বিষয়ে কম আলাপ করে তাদের অর্থবিত্ত, অর্জন, সম্মান নিয়ে প্রশংসা করে যাবেন।
৪.দ্যা এটাচার ( দুষ্ট শিষ্য): যদি ভাল অবস্থানে থাকেন হঠাত করে এমন শিষ্য বা চেলা পাবেন। এরা হয়ত কোন কোয়ালিটির কারণে তাদের বস/গুরুকে পছন্দ করে কিন্তু ভেতরে হিংসা অনুভব করে ও বাশ দেয়ার প্রস্তুতি নেয়। এরা ক্ষমতাশালী বড় কারো আশেপাশে জুটে যায় তাদের ক্ষতি করার লোভে! এরা জীবনের প্রকৃত কোন উদ্দেশ্য খুঁজে পায় না, ভেতরে শুন্যতা অনুভব করে। তাই যাদের মধ্যে কোন বড় উদ্দেশ্যে ও সম্ভাবনা খুজে পায় তার সাাথে লেগে থাকে, কিন্তু পরে ক্ষতি করে। চাটুকারিতা করে সম্পর্ক করবে, তারপর বসের/গুরুর সব হাড়ির খবর জেনে নিয়ে বদনাম করবে, গসিপ করবে। যদি কাউকে কাজে হায়ার করেন বা শিষ্য হিসেবে নেন, চার্মিং পার্সোনালিটির পরিবর্তে সংশ্লিষ্ঠ কাজে অভিজ্ঞতাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন।
৫.ইনসিকিউর মাস্টার (হিংসুটে বস):কেউ কেউ কোনভাবে হয়ত টপ/লিডারশিপ পজিশনে চলে যাবে। নিজেরাই শিউর না তারা এর যোগ্য কিনা। অধীনস্ত যাদের মধ্যে বেশি মেধা , যোগ্যতা তাদের দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। আপনি এদের ইম্প্রেস করার জন্য অনেক পরিশ্রম করবেন, কাজ করবেন -ফল হবে উল্টা। এরা মনে মনে আপনার তারুন্য, কর্মস্পৃহা , মেধা , ইচ্ছাশক্তিকে ঘৃণা করে। আপনার যোগ্যতার কারনে এবং সে যোগ্যতা তার না থাকার কারণে নানা গল্প ফেদে আপনাকে শাস্তি দেবে। বসদের মধ্যে বিনাকারণে কাউকে শাস্তি দেয়ায় অভ্যাস থাকলে লক্ষ্য রাখুন। এদেরকে আপনার পরিশ্রম , আইডিয়া, কাজ ও অর্জনের ক্রেডিট দিয়ে দেবেন। বেচে থাকলে পরে বড় কিছু হতে পারবেন , আগে নিজের রিজিক বাচান। ( আমি ব্যক্তিগতভাবে ভীষণ ভাগ্যবান, বস হিসেবে সবসময় কয়েকজন সেইন্ট, এঞ্জেল লেভেলের লোকজনকে পেয়েছি)।
.
হিংসানুভূতি জাগরণের কারণ (Envy Triggers):
কারো কারো মধ্যে হিংসানুভূতি তীব্র, তবে কিছু পরিস্থিতিতে সকলের মধ্যে হিংসানুভূতি জাগতে পারে। হিংসা বন্ধু, কলিগ কিংবা ক্লোজ সার্কেলের মধ্যে বেশি কাজ করে। হঠাত করে আপনার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হলে এদের সাথে সম্পর্ক পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে, হিংসার আক্রমণের সবচেয়ে উর্বর সময় এটা। খ্রিস্টের জন্মের অনেক আগেই মনীষী Hesiod বলেছেন, " কামার কামারকে, কুমোর কমোরকে আর লেখক লেখকদের হিংসা করে"। তবে প্যাসিভ হিংসাকে সাধারণভাবে নেয়া উচিত, করন একই কর্মপরিধিতে আমাদের মধ্যেও এমন হিংসা জাগতে পারে। ক্ষতিকর কিছু করে কিনা সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। লেখকরা হিংসার খনি। যারা ভাল লেখে , লেখে ভাল কামাই রোজগার করে, সম্মান পায়- অন্য লেখকরা হায়েনার মত তার উপর ঝাপায় পড়ে। অন্য যে কোন আর্টিস্টদের মধ্যেও এটা প্রকট।
এ ধরণের হিংসা থেকে বাচার উপায় হচ্ছে নিজেকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করা, অর্জনে ভাগ্যের সহায়ের কথা প্রচার করা। নিজের সাফল্য ভুলেও অন্যের চোখে আংগুল দিয়ে দেখাতে যাবেন না। করুনার ভংগি উদ্রেক না করে যতটা পারেন সকলকে বিপদে আপদে সাহায্য করবেন। মৃত না হলে এক কবি-শিল্পীর সামনে অন্যদের প্রশংসা করতে যাবেন না! আপনার পিয়ারদের মধ্যে একটিভ এনভি টের পেলে , যতটা পারেন দুরে থাকবেন। বয়সের কারণে ক্যারিয়ার যাদের শেষের দিকে, সেসকল অস্তগামী সূর্য বা অস্তমিত সূর্যদের ইগো খুব ভংগুর থাকে, এদের কে সাব্ধানে ডিল করবেন।
আমাদের মধ্যে কিছু প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রতিভাবানরা মেধা, চিন্তাশক্তি, সৌন্দর্য, এথলেটিজম পেয়ে নির্দিষ্ট ফিল্ডে সফলতার সাক্ষর রাখেন। এরা কিছুটা সরল প্রকৃতির, হিংসা করেন না, অন্যরা করলেও বুঝতে পারেন না। ফলে বেশি পরিমাণ হিংসার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হ'ন। হিংসা যাদের গায়ে লাগে না হিংসুটেরা তাদের উপর আরো শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। আপনার কোন ন্যচারাল ট্যালেন্ট থাকলে সব জায়গায় দেখাতে যাবেন না। বরং, সচেতনভাবে নিজের কিছু ত্রুটি প্রদর্শন করবেন। যেমন বিজ্ঞান গবেষণায় আপনার সাংঘাতিক ট্যালেন্ট আছে, ভাব ধরবেন ব্যক্তিযোগাযোগে আপনি দুর্বল। নিজের সাব্জেক্টের বাইরে বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতা প্রকট করে তুলে ধরবেন।
সফল নারীদের হিংসুটেরা মৌমাছির ঝাকের মত আক্রমণ করে। যে কোন সমাজে সফল নারীর উজ্জ্বল অবস্থান, নেতৃত্ব, সুনাম ইত্যাদি হিংসা ও শত্রুতা ডেকে আনে। এদেরকে শীতল, নাক-উচা, উচ্চাভিলাষী, অরমনীয় ইত্যাদি ট্যাগ দেয়া হয়। পুরুষদের ভাল কিছু অনুকরণযোগ্য হিসেবে ভাবা হয়, মেয়েদের সফলতা দেখে ছেলে-মেয়ে উভয়ের মধ্যে ইনফিরিওটি প্রবলতর হয়। ফলে সফল নারীরা নির্বিচারে হিংসা ও শত্রুতার স্বীকার হয়, প্রাপ্য সম্মান পান না। মেয়েদেরকে যাদের ভালোবাসে তারাও হিংসে করতে পারে। ভালবাসা ও হিংসা মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ না। এত হিংসা নিউট্রালাইজ করতে মেয়েদের অতিরিক্ত শক্তি ক্ষয় করতে হয়।
হিংসা আক্রমনের স্বীকার হয়ে গেলে বেস্ট স্ট্রেটেজি হল মেজাজ ঠান্ডা রেখে ঝিম মেরে পড়ে থাকা। হিংসার সোর্স বুঝতে পারলে এটা সহজ। রিএকশন করলে হিংসুটে এটাকে পুজি করে আপনার আরো ক্ষতি করে দেবে, তাদের হিংসাকে জাস্টিফাই করবে। কখনো হিংসুটের সাথে রিলেশন মেরামত করতে যাবেন না। রাগ আর হিংসা আলাদা। রাগ বা অন্য শত্রুতাকে আপনি সেরা বন্ধুত্বে কনভার্ট করার সুযোগ পাবেন, হিংসুটেকে খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না। এদেরকে আপনি বন্ধু বানানোর বৃথা চেষ্ঠায় পিঠে হাত রেখবেন, এরা পুনরায় আপনার পশ্চাতদেশে আংগুল দেবে। সর্বশক্তি দিয়ে তাদের বদনাম গসিপ প্রতিরোধ করতে পারেন, কিন্তু প্রতিশোধ নেয়ার কথা মাথায় আনবেন না। নিজেদের বিষ নিজেরা হজম করুক, চির অসুখী থাকাই তাদের বড় শাস্তি।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে পৃথিবীর ইতিহাসে এ মুহুর্তে হিংসাচাষীর সংখ্যা সর্বাধিক। বন্ধু, সিউডো-বন্ধু, সেলেব্রেটি সকলের এক্সাইটিং মুহুর্তের, সুন্দর পারিবারিক সময়ের, ভ্যাকেশনের, সাফল্যের, ভালো সময়ের ফিল্টার করা অতিরঞ্জিত ছবিগুলো আমরা প্রতিনিয়িত পাচ্ছি। এতে আমাদের মধ্যে নিচু লেভেলের হিংসাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ভাসমান হিংসাগুলো বিরাট জনসংখ্যার মধ্যে বিরাজ করলে সুযোগ সন্ধানী নেতৃত্ব কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির বিরুদ্ধে এ শক্তিকে লেলিয়ে দিতে পারে। কেউ স্বীকার করবে না, কিন্তু এটা সত্য যে, হিংসার শক্তিও বিরাট সংখ্যক মানুষকে একত্রিত করতে পারে। অন্যকে অপমানের তীব্র আনন্দে ( schadenfreude ) সাম্প্রতিক ভাগ্যহত কোন পাবলিক ফিগার এই শক্তির টার্গেট হতে পারে। শক্তিমানের বিরুদ্ধে হিংসা- নিন্দা একটা বিজনেস ইন্ডাস্ট্রি।
.
নিজের হিংসারোগ থেকে আরোগ্যের উপায়সমূহ:
আমরা কেউ ফেরেস্তা না, আমাদের মধ্যেও হিংসা বাস করে। তবে উপযুক্ত চেষ্ঠা, চিন্তা , প্র্যাক্টিসের মাধ্যমে এ হিংসাকে পজিটিভ উতপাদনকারী শক্তিতে পরিণত করতে পারি। কারো উপর রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা উপলব্ধি করলেও এটা যে বেশিরভাগ সময় হিংসা তা স্বীকার করে চিহ্নিত করতে হবে।
যা হিংসা করেন তার কাছে গিয়ে দেখুন: যার ক্ষমতা , পরিচিতি , অর্জন , প্রদর্শন দেখে একটু হলেও হিংসা করেন তাকে খুব কাছ থেকে পাঠ করলে দেখবেন উল্টা। একটা ভাল অবস্থানের জন্য তাকে কতটা শত্রুতার মোকাবেলা করতে হয়, ভাল থাকার জন্য কত পরিশ্রম করতে হয়, কত বসের কত উল্টাপাল্টা প্যাদানি খেতে হয় এসব দেখলে আপানার হিংসা উড়ে যেতে বাধ্য। কাছে গিয়ে দেখবেন, তার প্রদর্শিত অনেক সাফল্য বা ভালোকিছুই আসলে মেকি, এর চেয়ে আপনি ঢের ভাল আছেন।
নিচের দিকের তুলনা করুন: শুধুমাত্র উপরের দিকে দীর্ঘশ্বাস না ফেলে নিচের দিকে তাকান, আপনার চেয়ে কতশত জন খারাপ অবস্থায় আছে, না পেয়ে বা অল্প পেয়ে জীবনের সাথে সংগ্রাম করে যাচ্ছে- তাদের দেখলে আপনার নিজের অর্জনের জন্য কৃতজ্ঞ থাকবেন। হিংসার যেমন মাসল মেমরি আছে, কৃতজ্ঞতার মাসল মাসল মেমরি তৈরির জন্য আপনাকে প্র্যাক্টিস করতে হবে। সবকিছুর জন্য কৃতজ্ঞতা আপনার হিংসাকে দূরীভূত করবে।
অন্যের সাফল্যে আনন্দিত হওয়া প্র্যাক্টিস করুন: Shcadenfreude বা অন্যের ভালো দেখে কষ্ট পাওয়ার বিপরীত হচ্ছে Mitfruede বা অন্যের সুখে সুখী হওয়া। অন্যের অর্জনে শুকনা অভিনন্দন না জানিয়ে মন থেকে তার সুখকে অনুভব করার চেষ্ঠা করুন। তার ভালোর সাথে একাত্বতা ঘোষণা করুন, অনেক ভাল বন্ধু পাবেন। বারবার অভ্যাসের মাধ্যমে অন্যের সুখের অনুভূতি অনুভব করার মাধ্যমে আপনার ভেতরে সুখানুভূতি ছড়িয়ে যাবে।
হিংসাকে শক্তিতে পরিণত করুণ: আমাদের চেয়ে সুপিরিয়রদের অর্জনগুলোকে হেয় না করে তাদের পরিশ্রম, ওয়ার্ক এথিক , ফোকাস, স্ট্রাগল ইত্যাদিকে অনুরসরণ করে আমাদের হিংসার নেগেটিভ শক্তিকে পজিটিভ শক্তিতে পরিবর্তন করতে পারি। অন্যের সাথে তুলনায় নিজের মহত্ব আসে না, বড়ত্ব আসে নিজের ভেতরের সাথে লড়াইয়ের মাধ্যমে। সকল বাধা বিপত্তি ছাড়িয়ে লক্ষ্য অর্জন করে জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়ার ভেতর। অন্যের অর্জন এক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখতে পারি। হিংসুটেরা অলস ও ইন্ডিসিপ্লিন্ড, তাই অলসতা পরিহার করে ডিসিপ্লিন্ড হোন, ভালো কিছু হবেই।
মানুষের মহত্বকে সম্মান করুন: সৃষ্টির সবচেয়ে বুদ্ধিমান জীব মানুষ। অন্য এক ভাইয়ের অর্জনে খুশি হওয়া, অনুপ্রাণিত হওয়া , নিজেকে নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্ঠা, একে অপরকে সাহায্য করার অভ্যাসগুলো মানুষ হিসেবে আমাদের জন্মকে মহিমান্বিত করবে।
.
সোর্স: বই: দ্যা লজ অব হিউম্যান নেচার, লেখক: রবার্ট গ্রিনে , অধ্যায়: দ্যা লজ অব এনভি, পৃষ্ঠা: ২৬১-২৯০।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন