রুগ্ন গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো

 বছর দুয়েক আমেরিকায় ছিলাম। শহরের নাম সিটি অফ কলেজস্টেশন। টেক্সাস এএন্ডএম  ইউনিভার্সিটি  আদিকালে কলেজ ছিল।  কলেজের ধারে রেলস্টেশন ।  স্টেশনের নামে  শহরের নাম  সিটি অফ কলেজস্টেশন। 

  

বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক লোকজন শহরে বসবাস করে,  উচ্চ শিক্ষিতের হার  বেশি। ২০২২ সালে   মেয়র নির্বাচিত হন জন নিকোলস।  নির্বাচনে ৯৫হাজার  ভোটারের মধ্যে ২১হাজার  ভোট পড়ে।  ভোট প্রদানের হার ২২%।  তবে গতবার ছিল ব্যতিক্রম,  এর আগের নির্বাচনগুলোতে ৭% ,  ১০% পর্যন্ত ভোট কাস্টিং হয়েছে। 


 শুধুমাত্র সিটি মেয়র নয়,  কাউন্টি জাজ,  স্কুল  ডিস্ট্রিক্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ, স্টেট গভর্নর পর্যন্ত নানা জাতের স্থানীয় সরকার পদ  ঐ দেশে।  কমবেশি হতে পারে,  তবে সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এ সকল পদে  ভোটার টার্নআউট  ৫% থেকে ৩০% এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। শুধু  আমেরিকা নয়,  কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের  নানা দেশে লোকাল গভর্মেন্টের সকল পদে  চিত্র মোটামুটি একই। 


 উন্নত দেশে স্বল্প  ভোটার টার্ন আউটের  নানাবিধ রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণ রয়েছে, সবচেয়ে দৃশ্যমান কারণ হচ্ছে প্রচার-প্রচারণার  নিদারুণ অবস্থা।  আমি এবং আমার এক বন্ধু নিজেদের মত করে হিসাব করে দেখেছি,  আমেরিকার অনেক সিটি মেয়র হওয়ার চেয়ে বাংলাদেশের বড় সাইজের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সগুলোর  পরিচালনা কমিটির সভাপতি-সেক্রেটারি হওয়া অধিকতর লাভজনক,  এখানে ভোট কাস্টিং  প্রায় শতভাগ,  প্রচারণা রমরমা ।  খরচাপাতি মেলা, নির্বাচিত  হলে সে খরচ উঠেও  আসে।


তবে উন্নত দেশের  জাতীয় ইলেকশন গুলোর ভোটার টার্ন আউট আরেকটু বেশি। সুইজারল্যান্ডে ২০১৯ সালের নির্বাচনে ৪৫% ভোট কাস্ট হয়েছে।  আমেরিকায় ২০১৬ সালের ও   জাপানের  ২০২১-এর নির্বাচনে  ৫৫%  ভোট  হয়েছে। পর্তুগালে ২০১৯ সালের নির্বাচনে ৪৮% , রোমানিয়ায় ২০২১ সালের নির্বাচনে ৩১% ভোট পড়েছে।  যে সব দেশ অধিকতর সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার  কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে, তাদের ফেডারেল ইলেকশনে ভোটারদের অংশগ্রহণ আরেকটু বেশি।  তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে  কাস্টিং অল্প। অনেক দেশ আবার ভোট বাড়ানোর জন্য ভোট না দিলে শাস্তির ব্যবস্থা করে আইন করেছে, তবে খুব কাজে লাগে বলে মনে  হয় না। 


অর্থাৎ বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে   উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক ভোটার ভোট দিতে যায় না, বা ভোট দিতে পারে না,  বা দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না।  এর মাধ্যমে গণতন্ত্রের যে প্রকৃত মূল্যবোধ অর্থাৎ সবার মতামতের ভিত্তিতে সকল স্তরে জনগণের শাসনব্যবস্থা প্রচলন –সেটি  আদৌ বাস্তবায়িত হয় কিনা তা আলোচনা সাপেক্ষ।  আমরা ওদের জাতীয় নির্বাচনগুলো ফলো করি, ফলে  বুঝতে পারি না।  কিন্তু স্থানীয় সরকার পর্যায়ে এই দেশগুলোর গণতন্ত্র মোট্মুটি সংকটের মধ্যে আছে, বলতে গেলে স্থানীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশে এসব দেশে  গণতন্ত্র প্রায়   মৃত। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠিত  গণতন্ত্র হিসেবে দাবি করা দেশগুলোতেও  গণতন্ত্র  ইতোমধ্যে সাংঘাতিকভাবে রুগ্ন। ভবিষ্যতে তরতাজা হওয়ার  সম্ভাবনা খুবই কম। 


উন্নত দেশের  নির্বাচনে  ৫%,  ১০% ভোট দিয়ে   প্রতিনিধি নির্বাচন করা হলেও সেখানে প্রশাসন খারাপ না।  দেশগুলোর প্রশাসনিক কাঠামো একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। কেউ খুব নেতিবাচক কিছু করে সুবিধা করতে পারবে এ সুযোগ খুব কম। তবে ভোটার সংকটের কারণে পৃথিবীব্যাপী সৃষ্ট এই গণতান্ত্রিক সংকটের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এর সমাধান। 


বর্তমান সময়ে  আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স,  মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অফ থিংস, বিগ  ডেটা প্রসেসিং   ইত্যাদি যে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে 

এগিয়ে যাচ্ছে,  এই মেশিন, ডেটা আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই ভবিষ্যতে এ সংকটের সমাধান হিসেবে এগিয়ে আসবে। 


 


আমরা কে, কখন, কোথায়  কি করি, কার সাথে মিশি, আমাদের বিদ্যাবুদ্ধি  যোগ্যতার দৌড় কতটুকু,  আমাদের শক্তিমত্তা ও দুর্বলতা অর্থাৎ প্রায় সকল বৈশিষ্ট্য আমরা নিজেরা  যতটুকু জানি, আমাদের হাতে থাকা ইন্টারনেট যুক্ত ডিভাইস গুলো তার চেয়ে আমাদেরকে বেশি ভালো জানে।  ২০২৪ সালে যা হচ্ছে ২০১৪ সালে তা কল্পনাও করা যেত না।  অর্থাৎ এ লাইনে যা ঘটছে তা সবকিছু দ্রুততার সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে।  দ্রুত পরিবর্তনশীল  আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ইন্টারনেট অফ থিংস,  বিগ ডাটা ও মেশিন লার্নিং এর সময়ে পৃথিবীর নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি মেশিন নির্ভর হয়ে উঠার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। 


  

কর্পোরেট লেভেলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে  ক্যান্ডিডেট সিলেকশনে ইতোমধ্যে স্বল্প আকারে  প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে।  ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা ফুটপ্রিন্টগুলো থেকেও এ লক্ষ্যে অনেক তথ্যমূলক সহযোগিতা পাওয়া যায়। নির্বাচন ব্যবস্থাতেও এর সম্প্রসারণ হবেই। 


আগামী দিনে ডেমোক্রেসির বিকল্প হবে ‘মেশিনোক্রেসি’। 


খুব দ্রুতই কোন কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে সেটা বলছি না।  শুরু হতে পারে কোন উন্নত দেশের কোন উন্নত শহরে। যেখানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটার হার ৫-১০ পার্সেন্ট বেশি হয় না সে রকম একটি জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে মেশিনকে দেয়া হবে নির্বাচনের এ দায়িত্ব।  শখানেক  সুপার কম্পিউটারকে নির্ধারিত এলাকা থেকে সবচেয়ে ভালো প্রার্থী  খুঁজে বের করতে,  কিংবা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্য থেকে যোগ্য প্রাপ্তিকে নির্বাচন করার জন্য এভেইলেবল সকল তথ্য বিশ্লেষণ করে আউটপুট দেবে।  বর্তমানের আর্টিফিশাল ইন্টেলিজেন্সের ক্যাপাসিটিতেই

প্রচলিত নির্বাচনের চেয়ে মেশিনের মাধ্যমে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব।  


প্রশ্ন আসতে পারে মেশিনোক্রেসিতে,  নির্বাচিত প্রার্থী নিয়ে কোন বিতর্ক হবে কি না?হ্যা,   অবশ্যই হবে।  এখন যেমন ভোট কারচুপি,  আমেরিকান নির্বাচনে রাশিয়ার প্রভাব,  সংখ্যালঘু কার্ড খেলা,  ইমিগ্রেশনের তুলে ধরা ইত্যাদি যে বিতর্কগুলো আছে সেগুলো হয়তো অন্যভাবে উঠে আসতে পারে।  তবে সিস্টেমের সদিচ্ছা থাকলে এ সমস্যাগুলো থেকে বের হয়ে আসা বর্তমান বর্তমানে বর্তমানের সিস্টেম থেকেও সহজ হবে।  এই যে প্রচলিত সিস্টেমে জমজমা নির্বাচনের মাধ্যমে কত রক্ত/খেকো যু/দ্ধবাজ, ভিনদেশের সম্পদ লুণ্ঠ/নকারী কিংবা ভবিষ্যতের স্বৈরাচার নির্বাচিত হয়ে থাকে তার কোন ইয়ত্বা নেই।  এগুলো হয়তো তখনো থাকতে পারে। 


ব্যক্তিগতভাবে আমি ২০২০ সাল থেকে আমার ক্লোজ সার্কেলে মেশিনোক্রেসি নিয়ে মাঝেমধ্যে কথা বলি।  এ অনুমানকে খুব সিরিয়াসলি  না নিলেও চলবে।  তবে অনুমান করছি ২০৫০-২০৬০ এর দশকে স্থানীয় নির্বাচনে মোটামুটি চালু হয়ে যাবে।  ৭০-৮০ এর দশকে কোন কোন রাষ্ট্র তার কেন্দ্রীয় নির্বাচনে মেশিনেক্রেসি শুরু করে দিলে অবাক হবো না।  এ শতাব্দীর শেষের দিকে বা আগামী  শতাব্দীর শুরুর মধ্যেই বর্তমান প্রচলিত নির্বাচন ব্যবস্থা একেবারে নাই হয়ে যেতে পারে।  বর্তমান ডেমোক্রেটিক দেশের মোনার্কিতে যেমন প্রতীকী রাজা থাকে তেমনি হয়তো কোথাও কোথাও প্রতিকী দু-একটি গণতন্ত্র শোভা পেতে পারে।  


মেশিন রাজত্বের  তত্বীয় ভিত্তি দাঁড় করাতে গেলে সাহায্য নিতে পারি আমেরিকান দার্শনিক জন রলস ও অমর্ত্য সেনের ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচারের প্রপোজিশনগুলোকে। তাঁদের  “এ থিওরি অব জাস্টিস" ও “দ্যা আইডিয়া অব জাস্টিস” বইগুলোতে আলোচিত কাঠামোর মধ্যেই মেশিনোক্রেসিকে দাড় করানো সম্ভব। 


রলসের মতে, একটি ন্যায়সঙ্গত সমাজে সকল সদস্যের মধ্যে সহযোগিতা থাকতে হবে। তিনি "ভেলভেট রুল" ধারণা উপস্থাপন করেন, যা নির্দেশ করে যে, সমাজের সকল সদস্যকে তাদের স্বার্থের বাইরে ভাবতে হবে। 


অমর্ত্য সেনের মতে, ন্যায়ের ধারণা একটি আদর্শ সমাজের উপর ভিত্তি না করে, বরং বাস্তব জীবনের পরিস্থিতিতে ন্যায়বিচারকে মূল্যায়ন করা উচিত। ন্যায়কে মানুষের জীবনের গুণগত মান উন্নয়নের সাথে যুক্ত করতে হবে, যা মানুষের ক্ষমতা ও সুযোগের উপর নির্ভর করে। ন্যায়ের ধারণা বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলির মোকাবেলা করতে হবে এবং এটি শুধুমাত্র তাত্ত্বিক আলোচনা নয় বরং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত হতে পারে।


অর্থাৎ বর্তমান ডেমোক্রেসিতে অংশগ্রহণকৃত ৫%-১০% ভোটারের ভোট সকলের ন্যায়সঙ্গত অংশগ্রহণ নাকচ করে। কেউ হয়তো ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আর্থিক বা শারিরীক শক্তি রাখেন না, অনলাইনে ভোট দেয়ার সংগতিও নাই, ভোট দেয়ার মানসিক শক্তি পান না, প্রার্থী সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ তথ্য পান না,  ব্যায়বহুল পিআর ফার্মদ্বারা প্রোপাগান্ডা হজম করেন।  অর্থাৎ প্রচলিত ভোটিং সিস্টেমে তার ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে পারেন না। 


তাই প্রচলিত সিস্টেম অন্যায়। এটা বইতে ইনক্লুসিভ দেখালেও বাস্তবে ঘোড়ার আন্ডা। অবাধ তথ্যপ্রবাহ ও প্রসেসিং এর মাধ্যমে প্রকৃত যোগ্য ব্যাক্তি বা প্রার্থী পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রচলিত ডেমোক্রেসির চেয়ে মেশিনোক্রেসি অধিকতর কার্যকর ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা  রাখার সুযোগ রয়েছে।  


উন্নত দেশে একবার চালু হয়ে গেলে তারা এই সিস্টেম অনুন্নত দেশে ফেরি করে বিক্রি করবে, এখন যেমন ফেরি করে লিবারেল ডেমোক্রেসি ও নিওলিবারেল ফ্রি মার্কেট একনোমিকে। 


২১২৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা না করে নিতঁশে থেকে থেকে ধার করে ঘোষণা দিয়ে দিলাম “ডেমোক্রেসি ইজ ডেড”!!


( যারা একাডেমিক রাইটিং করেন তারা এ নিয়ে  আরো গভীরভাবে ভাবতে পারেন ও কাজ করতে পারেন,  আমার সহযোগিতা লাগলে আমি হেল্প করতে পারবো,  আর আপনারা নিজে নিজে করলেও শুভকামনা রইল। কন্সেপ্টের ক্ষুরধার সমালোচনা স্বাগত জানানো হবে।)

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত

আধুনিক আমলাতন্ত্র: ওয়েবার থেকে ইভানস

চেপে রাখা অর্থণীতি: মুক্তবাজারের মিথ্যাবাজার

জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কথন

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

বিনির্মাণঃ ধ্বংসাত্মক সমালোচনার বৈধতা

সজল রোশানের ' রিলিজিয়াস মাইণ্ডসেট' কেমন?

ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রচিন্তা: আলথুসেরের রাষ্ট্রপাঠ