মৃত্যুচিন্তা
পৃথিবী নামক গ্রহের জন্মের সম্ভাবনা ছিল প্রায় শূন্য। পিতামাতার মিলন এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা, এবং আমাদের জন্মও একটি মহাঅলৌকিক ও অনিশ্চিত ঘটনার সাক্ষী। আপনার বা আমার জন্ম না হওয়ার লক্ষ কোটি কারণ ছিল, কিন্তু আমাদের মৃত্যু সবচেয়ে সুনিশ্চিত ও অবশ্যম্ভাবী। আমরা কত পার্থক্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করি—কেউ গরীব, কেউ ধনী, কেউ সাদা, কেউ কালো। মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় মার্ক্সবাদী আজরাইল বা যমদূত সবাইকে ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়ে অন্তিম সাম্য প্রতিষ্ঠা করেন এবং আমাদের সবাইকে এক বিন্দুতে মিলিত করেন।
মানুষই বা কেন, ধোঁয়া বা কুয়াশার সাথে আমাদের কোনো পার্থক্য নেই। আমরাও দূর শুন্যে মিলিয়ে যাই। কিন্তু হায়, আমরা প্রায় সকলেই জীবন অতিবাহিত করি মৃত্যুচিন্তা এড়িয়ে। এ এক মহাভুল। আধুনিক পুঁজিবাদী শহুরে জীবন মৃত্যুকে গোপন করার এক মহাপ্রচেষ্টা। মৃত্যু হয় হাসপাতালে, কবর হয় দূর গোরস্থানে। আপনজন কেউ মারা না গেলে জানতেও পারি না যে প্রতিদিন কত শত মানুষ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করছে।
আমরাও কত প্রচেষ্টা নিই, কত কিছু করি এ চিন্তা এড়িয়ে যেতে। ভুলে থাকি আমাদের সবচেয়ে নিশ্চিত গন্তব্য মৃত্যু। কত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাতিয়ে রাখে আমাদের সমাজ, মিডিয়া, প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই নিশ্চিত গন্তব্যস্থল স্মরণ করিয়ে দেওয়ার মতো কিছু নেই আমাদের সাথে। আজকে আমরা যাদেরকে দেখছি, ১০০ বছর পর এদের কেউ থাকবে না। মৃত্যুর ১০ বছর পর হয়তোবা কেউ কেউ আমাদের নাম নেবে, ২০-৩০ বছর পর স্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যাবো। আমাদের মৃত্যু হবে আপনজনদের অনেকদিন পর মিলনের এক মহাউৎসব, তারপর যে যার মতো চলে যাবে।
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এত বিশালতার মাঝে পৃথিবী ছোট্ট একটি গ্রহ। আমরা তাতে বসবাসকারী নগণ্য একেকটি প্রাণী। এখানে কয়েকদিন বেশি বেঁচে থাকা, মৃত্যুর পর কয়েকজন আমার নাম উচ্চারণ করায় খুব বেশি কিছু যায় আসে না। আপনি-আমি মরে গেছি মানে মরে গেছি। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। পৃথিবীতে অমরত্ব বলে কিছু নেই। ইতিহাসের সর্বোচ্চ পেছনে গিয়েও আমরা হয়তো চার হাজার বছর আগের এক-দুজনের নাম বলতে পারি, দুই হাজার বছর আগের তিন-চার জনের নাম বলতে পারি, ১০০ বছর আগের ১০০ জনের নাম বলতে পারি। বাকি সবাই গোরস্থানে, মৃত্যু সবাইকে দৃষ্টির অনেক বাইরে নিয়ে চলে গেছে। সুতরাং আমরা কেউ অমর হবো—এ এক অলীক কল্পনা, সুখ ফ্যান্টাসি মাত্র।
সিলিকন ভ্যালির টেক জায়ান্টদের অমরত্ব নিয়ে অবসেশন উন্নতমানের স্টুপিডিটি। যদি কোনভাবে তারা সফল হয়, সেটা হবে একটা ডিজাস্টার। বিজ্ঞানের ভাষায় মৃত্যু যন্ত্রণা কোন শাস্তিকর পদ্ধতি না। আমরা যেমন ঘুমের ঠিক আগের মুহূর্তের টের পাই না যে ঘুমিয়ে যাচ্ছি, ঠিক তেমনি স্বাভাবিক মৃত্যু হচ্ছে গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়া। শুধু এ ঘুমের কোন শেষ নেই। কষ্ট বা শাস্তি যেগুলোর কথা আমরা জানি, সেগুলো হচ্ছে রোগ-শোক বা দুর্ঘটনা জনিত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।
আমরা আরো ভালো থাকবো, সামনের দিনগুলো অনেক বেশি আনন্দঘন হবে—এও হবার নয়। যতদিন যায়, জীবনের জটিলতা তত বৃদ্ধি পায়। আমরা যাদেরকে নিয়ে সামনের দিনগুলোর অর্জন উপভোগ করবো, সবাইকে নিয়ে সব মিলিয়ে ভালো থাকবো—দেখি এক সময় হঠাৎ তারা চলে যায়। পিতা-মাতা মুরুব্বীরা চলে যায়। হঠাৎ করে আমাদের সমসাময়িকরাও চলে যায়। এমনকি আমাদের ছোটরাও চলে যায়। আমরা কত পরিকল্পনা করি, সামনের দিনগুলো অনেক সুন্দর করে যাপন করব নানা আয়োজনে, হাসিখুশি থাকবো—কিন্তু যাদেরকে নিয়ে এত পরিকল্পনা, মৃত্যু তাদেরকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
'জীবন এত ছোট যে তোমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এটা পার করে দেয়া যায়।'- ইমতিয়াজ মাহমুদ।
আমাদের কল্পিত ভবিষ্যৎ অলীক, মেকি। মৃত্যু মনে করিয়ে দেয় আমাদের সময় কত সীমিত। যদি কাউকে এপ্রেশিয়েট করার দরকার হয়, তাহলে কত বেশি এবং কত দ্রুত করা যায়, সে চেষ্টাই নেয়া উচিৎ। আমাদের যা আছে, সব কেড়ে নেওয়া সম্ভব, কিন্তু আমার হাতের এ বর্তমান মুহূর্ত কেউ কেড়ে নিতে পারে না। বর্তমান মুহূর্তটাই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়, সর্বোচ্চ সম্পদ। এটাইকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে, ফোকাস করতে হবে। এক মিনিট নষ্ট করার মানে হয় না। আমাদের বুঝে নিতে হবে আমাদের প্রায়োরিটি, জেনে নিতে হবে সত্যিকার অর্থে কি ম্যাটার করে, কি ম্যাটার করে না। আজ বাদে কাল কি হবে আমরা জানি না। আজ সকালে যে প্রিয়জনের সাথে কথা হয়েছে, রাতে হয়তো তার সাথে আর কথা হবে না। আজ যার সঙ্গ পেয়েছি, কাল তার জানাজায় যেতে হবে—এমন এক লটারির টিকেট হাতে বসে আছি আমরা।
আপনার আমার সাথে এক কোটি পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু একটি সুনিশ্চিত মিল হল আমরা দুজনেই এক সময় এ পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেব। আজকে হেলদি আছি, সব সময় থাকব—এখন আমার সব আছে, পরেও সব থাকবে—আজকে যা করতে পারছি, যাকে এখন কাছে পাচ্ছি, তাকে সব সময় পাব—এগুলো আসলে হবার নয়। মনে রাখবেন, পৃথিবীর একটি ধূলিকণাও ফরএভার গ্র্যান্টেড না। কেউ না, কিছুই না।
মানব জীবনের অন্যতম বড় একটি ক্রাইসিস হল নিজের পোটেনশিয়ালিটি সর্বোচ্চ ব্যবহার না করা। বিশেষ করে আমরা যারা পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসায়, এটা সেটা করি, একটা লেভেল পর্যন্ত আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়, একটা ঘোরের মধ্যে থাকি। কিন্তু ঘোর কেটে গেলে, বয়স যখন ৪০-৫০ এর মাঝামাঝি থাকে, তখন হিসেব কষতে বসি, জীবনে কি চেয়েছিলাম আর কি হয়েছে—গ্যাপ কতটুকু রয়েছে? হিসেবের খাতায় দেখতে পাই জীবনের শুরুর দিকে যে বড় বড় স্বপ্নগুলো ছিল, এতদিনে এগুলো ফিকে হয়ে গিয়েছে। নতুন করে করার আর কিছুই নেই। তখন না আছে শক্তি, না আছে ইচ্ছা। সবকিছু কেমন যেন অর্থহীন মনে হয়। এটার আমরা রোমান্টিক নাম দিয়েছি মিডল এজড ক্রাইসিস। তখন একট মৃত্যু কিন্তু আমাদের হয়ে যায়।
হর হামেশাই লোকজন বলে, দুই দিনের দুনিয়া, হেসে খেলে ফুর্তি করে যাই। টেকনিক্যালি অথবা বায়োলজিক্যালি, হেসে খেলে ফুর্তি করার কোন সুযোগ প্রকৃতি আমাদের জন্য রাখেন নাই। আমাদের যে বায়োলজিক্যাল প্রসেসের মধ্য দিয়ে বড় হয়ে উঠি, এখানে সবসময় হাসি খুশির কোন স্থান নেই। হাসি-ফুর্তির মূল কারণ ডোপামিন, সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন, এড্রেনালিনসহ বেশ কিছু হরমোনের কম বেশি হওয়া। আপনি যত কিছুই করেন, সর্বদাই হাই লেভেলে এসব হরমোন রাখতে পারবেন না। পারিপার্শ্বিকতার কারণে, সিচুয়েশনের কারণে এগুলো উঠানামা করবে এবং আপনি সর্বদাই হাসি খেলার ফুর্তি করার মুডে থাকবেন না। আসলে সুখ বা হাসি খেলা একটা সাময়িক অনুভূতি, এর কোন দীর্ঘস্থায়িত্ব নেই। ফলে যারা এই ধরনের চিন্তা করেন তারা আসলে বোকার দোজখে বাস করেন। হাসি-খেলা, সুখ কোন গন্তব্যস্থল নয়—এটি কি জার্নি। গন্তব্যস্থল মৃত্যু।
যদি জার্নির প্রসেসের মধ্যেই অন্তর্নিহিত মহৎ উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে এই পথে চলাটাই প্রকৃত সুখ। যখন বড় বিসর্জন করবেন, সময়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করবেন, বিনিময়ে আপনার আশেপাশের মানুষের কাজে লাগতে পারবেন, অন্য প্রাণী জগতের উপকারে আসবেন, তখন ধরে নিতে পারি মৃত্যুর কাছে আমাদের দেনা শোধ হচ্ছে। মৃত্যুর কথা মাথায় রেখে আমাদেরকে অধিকতর জীবিত করে তুলতে পারি, বাস্তবের সাথে মিশে যেতে পারি, বেঁচে থাকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারি, জীবনের অর্থগুলো খুঁজে পেতে নিবিড়ভাবে চেষ্টা করতে পারি।
আমাদের জীবনটাকে সত্যিকার অর্থবহ করতে হলে, ছুটে চলার পথটাতে পদচিহ্ন থাকবে, অন্যরা এই ফুটপ্রিন্টকে সম্মানকরবে। স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা যদি পূরণ করতে হয়, তাহলে এ সীমিত সময়ের মধ্যেই করতে হবে। খেয়াল করে দেখবেন, যে সকল ব্যক্তিবর্গ কোনভাবে মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখে এসেছেন, তাদের জীবনটা অন্যরকম। অনেক বড় কবি, লেখক, আর্টিস্ট, বিজ্ঞানী, সৃষ্টিশীল মানুষরা জানতেন তাদের সময় এমনকি স্বাভাবিকের চেয়েও সীমিত, যা করার দ্রুত করতে হবে, সীমিত সময়েই তাদের সেরা অবদান রেখে গেছেন। যেসকল রাষ্ট্রনায়কগণ মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে আসেন, তারা হন আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী, তাদের নেতৃত্ব হয় আরো শাণিত ও প্রখর। পুনর্জন্ম তাদেরকে জীবন মৃত্যুর স্বাদের মধ্যে রেখে সবকিছু সর্বোচ্চটা করিয়ে নেয়।
'মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যামসমান'
'মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবার চাই'—
রবি ঠাকুর দুই বয়সে দুভাবে মৃত্যুকে অনুভব করেছেন। মরণকে মহিমান্বিত করেছেন, আবার মানুষের মাঝে কর্মের মধ্য দিয়ে বাঁচার আকুলতা জানিয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুকে সামনে রেখে নিজের করণীয় ঠিক করেছেন, সেন্স অফ আর্জেন্সি সেট করে রেখেছেন। মানব জন্মের এই একটাই সত্যিকার অর্থে সুযোগ রয়েছে—যে সুযোগ আমরা গ্রহণ করতে পারি। আমাদের কর্মের মাধ্যমে কেউ একটু ভালো থাকতে পারে, জ্ঞান লাভ করতে পারে, কেউ একটু পথের দিশা পেতে পারে—এটাই আমাদের জীবনের সর্বোচ্চ অর্জন হিসেবে ধরে নেয়া উচিত।
মৃত্যুর কাছে এই একটি মাত্র দায় আমরা পরিশোধ করতে পারি জীবিত অবস্থায়। মৃত্যুকে মেনে নিলে, সর্বদাই স্মরণে রাখলে জীবনের সকল ব্যর্থতা, না পাওয়া, আপনজনের চলে যাওয়া মেনে নেয়া অনেক সহজ হয়ে যায়। আমরা নোয়াখালী লন্ডনীদের ভালোবাসি, কারণ আমিও নোয়াখালীর বা লন্ডনের। আমাদের সামান্য এ মিল আমাদের কত আপন করে দেয়। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে বড় মিল তো আমরা সবাই মরণশীল। এ ভাবনা আমাদের কূপমন্ডুকতাকে ছিন্ন করে, সকলের সব বিভেদ দূরে তাড়িয়ে, সকল মানুষ, সকল প্রাণীকে গভীরভাবে ভালোবাসতে শেখাতে পারে।
আমরা সকলেই যেহেতু গোরস্থানের আশেপাশেই বা ভেতরেই আছি, সুতরাং মাফ করে দেই আমাদের ভুলত্রুটিগুলো। আসুন, ভালোবাসি একে অপরকে। মৃত্যুকে অস্বীকার মধ্যে কোন বীরত্ব নেই, বীরত্ব আছে মৃত্যুকে স্মরণে রেখে, সামনের দিকে রেখে এগিয়ে চলা। আমরা জন্মেছি মৃত্যুর জন্য। মৃত্যুভয়কে এড়িয়ে চলা নয়, বরং মৃত্যুকে সামনে রেখে নিজের সময়ের সর্বোচ্চ মূল্যটা বুঝে নেয়া আমাদের ক্ষণস্থায়ী জীবনকে সার্থক করতে পারে। মৃত্যু ভয় কোন অপবিত্র ট্যাবু নয়, বরং এটাই হতে পারে আমাদের এগিয়ে চলার শক্তির প্রকৃত উৎস।
'আমি যে সত্যটি খুঁজছিলাম - এই সত্যটি মৃত্যু। মৃত্যুও অন্বেষী। চিরকাল আমাকে খুঁজছে। তাই - আমরা শেষ পর্যন্ত দেখা করেছি। এবং আমি প্রস্তুত। আমি শান্তিতে আছি।'—ব্রুস লি।
ইনস্পায়ার্ড বাই: রবার্ট গ্রিন, নিটশে, শোপেনহাওয়ার।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন