ট্রেন্ড কেন নর্ম নয়?

 কেউ কেউ ফেসবুকার, ইউটিউবার , টিকটকার, ফুড ব্লগার হতে চাইলে মন খারাপ করার কিছু নেই। এটা আসলে সময়ের দাবী। বাংলাদেশীরা যে হতে চায় এমন না, সব দেশেই হতে চায়। যেখানে যেটা বেশি চাহিদা , হাইপ বেশি, পপুলারিটি বেশি, সাপ্লাই সেটার আসবেই। এটা এডাম স্মিথ বলে গেছেন। কথাটা সব সময়ের জন্য সত্য। 


১৭২০ সাল। সরকারের হস্তক্ষেপে স্টক মার্কেট রমরমা। বুদ্ধিমান ও পাকা এক ব্যক্তি নিজের বুদ্ধি ও দক্ষতাবলে কামানো টাকা হিসেব করে ইনভেস্ট করলেন 'সাউথ সি কোম্পানির' স্টকে। অল্পদিনে এই কোম্পানির শেয়ার আকাশে উঠছিল। চতুর এই লোক ঝোপ বুঝে কোপ মারলেন। ১০০% প্রফিটে সে সময়ে ৭০০০ পাউন্ড লাভ করলেন। যে শেয়ারের দাম জানুয়ারীতে ১২৮ পাউন্ড , জুলাইতে হাজার পার হয়ে যাচ্ছিল। 


তার আবার খচখচানি শুরু হয়ে গেল। আশে পাশে সবাই পাউন্ড ঢালছিল আর লাভের খবর দিচ্ছিল। পাউন্ডের গন্ধ  আকাশ বাতাস ম-ম করছিল। যারা পাচক, ক্লিনার, হোম সার্ভেন্ট হিসেবে কাজ করত, তারাও বাষ্প সকট কিনে ড্রাইভার রাখা শুরু করল, নিজেদের জন্যেই আবার পাচক ক্লিনার রাখা শুরু হলো।  স্মার্ট ব্যক্তিটি আর চুপ থাক্তে পারলেন না। লাভের টাকার সাথে আরো ধারদেনা করলেন , স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করলেন। এক-দুই মাস যেতে না যেতেই হটাত  বেলুন ফুটো হয়ে গেল, সেপ্টেম্বরের মধ্যে সাউথ সি কোম্পানির শেয়ারের দাম নেমে গেল ১৭৫ পাউন্ডে। এই লোক ২০,০০০ পাউন্ড গচ্চা দিলেন। এই সময়ের হিসেবে যা ৩মিলিয়ন পাউন্ড। এরপর তার সামনে কেউ 'সাউথ সি' শব্দ উচ্চারণ করলে জুতা দিয়ে মারতে যেতেন। 


এই স্মার্ট ব্যক্তিটির  নাম স্যার আইজ্যাক নিউটন। পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, প্রাকৃতিক দার্শনিক এবং আলকেমিস্ট। অনেকের মতে, নিউটন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ। সব বাদ দিয়ে অংক- হিসেবের  কথা বললে তাকে ক্যলকুলাস ও দ্বীপদি উপপাদ্যের অন্যতম আব্বাজান বলা যায়। 


যাইহোক, নিউটন ধরা খেলে আপনি আমি কিছুই না। যে কারণে এই আলোচনা তার নাম 'ম্যাডনেস অফ গ্রুপ'। এটি অত্যন্ত শক্তিশালী এক আবেগ, মানুষের  বিবর্তনের  ইতিহাসে অন্যতম প্রাচীন আবেগ। আপনি আমি কেউ এর উর্ধ্বে নই। গ্রুপ , ট্রাইবের মধ্যে দিয়েই আমরা বেড়ে উঠেছি। প্রাচীন কালে আগুনের চারদিকে দাড়িয়ে নাচানাচি করেছি, কেউ কেউ এখন এগুলোকে প্রার্থনা বলে। একসাথে বড় বড় হাতিঘোড়া শিকার করেছি। 


প্রাচীন কালের কথা বাদ।একটা সুন্দরী মেয়ে দেখলেও লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া গোবেচারা বন্ধুটাও কনসার্টে গেলে খেমটা নাচন দেয়। উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে গ্রুপের পাল্লায় পড়লে ভিতু পোলাটাও বন্ধুর বান্ধুবীর প্রেমিককে দলবেধে পেটাতে যায়। একপাতা ছিপাড়া পড়ি নাই, মাসে একবার জুম্মার নামাজ পড়িনা, কিন্তু  সবাই মিলে ধর্ম রক্ষার জন্য অন্য ধর্মের লোকজনকে শেষ করে দিতে যাই। 


আমরা সবাই আমাদের ডিএনএ এর নকশার মধ্যে যে লেখা- সে লেখার দাস। ক্যান উই ডিনাই দিস জেনেটিক  ম্যাডনেস অফ দ্যা গ্রুপ?


হ্যা, পারি। যখন দেখবেন সবাই যেটা করছে, সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, ট্রেন্ডকে নর্ম হিসেবে জাস্টিফাই করার জন্য অংশগ্রহণ করার নেশা চেপে বসেছে, উত্তেজনা কিলবিল করেছে , তখন প্লিজ স্টপ। ভেবে দেখুন , এটা আপনি কেন করতে যাচ্ছেন? উত্তর যদি হয় , সবাই করছে আমি না করলে কেমন দেখায়, সমাজে কি আর মুখ থাকবে, আশে পাশের লোকজন বোকা ভাববে। তাইলে আপনার আর এটা করার দরকার নাই, এই সমাজে কদিন পরে মুখ দেখান, কিছুদিন ভোদাই হিসেবে  নিজেকে পরিচিত করার রিস্ক নিন।


কিছুদিন বা কিছুমাস বা কিছুবছর পর দেখবেন আপনি সঠিক। অন্যরা ভোদাই। অন্যরা ম্যাডনেস অফ গ্রুপের ম্যাড।

মন্তব্যসমূহ

সর্বাধিক পঠিত

আধুনিক আমলাতন্ত্র: ওয়েবার থেকে ইভানস

চেপে রাখা অর্থণীতি: মুক্তবাজারের মিথ্যাবাজার

জাতিসমূহের অর্থনৈতিক ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত কথন

চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জসমূহ

বিনির্মাণঃ ধ্বংসাত্মক সমালোচনার বৈধতা

সজল রোশানের ' রিলিজিয়াস মাইণ্ডসেট' কেমন?

ভাবাদর্শিক রাষ্ট্রচিন্তা: আলথুসেরের রাষ্ট্রপাঠ