লিডারশিপ ফর লেডিজ
এর আগে লিডারশিপ নিয়ে একটি দীর্ঘ লেখা লিখেছি। এ অংশটুকু ঐ লেখাতে দিতে পারতাম। কিন্তু বিতর্ক তৈরি হতে পারত এবং লেখার মূল ফোকাস সরে যেতে পারত। অযথাই কিছু লোক ধর্মীয় ও কালচারাল ইস্যু টেনে ঘোট পাকাতে পারে, সে ভয়ে এ অংশ চেপে গিয়েছি।
আদিম গোত্র ভিত্তিক সাম্যবাদী সমাজে নেতৃত্বের পদ ছিল শামান বা মহিলা শামান। গোত্রের কালচার ও প্রয়োজনীয়তা উপর নির্ভর করে লিঙ্গভিত্তিক নেতৃত্ব নির্ধারণ করা হতো। তবে আদিম সমাজে প্রায়শই নারীরা দল পরিচালনা করত ও তাদের দেবদেবীদের সাথে যোগাযোগ রাখত।
কৃষি কাজের উদ্ভব পুরো সিস্টেমে একটা গোলমাল এনে দেয়। সম্পদের মালিকানার বিষয়ে চলে আসে, উত্তরসুরির প্রয়োজন হয়, বিবাহ প্রথা স্থায়ীত্ব লাভ করে। অধিক শ্রমিকের প্রয়োজনীয়তা হেতু মেয়েদের প্রেগনেন্সির পরিমাণ, মোট প্রেগনেন্সির সময়কাল ও সন্তান জন্মদান কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি লাভ করে । নেতৃত্বের জায়গাটি আস্তে আস্তে হাতছাড়া হয়ে যায়। বিষয়টি লক্ষণীয় যে, কৃষিকাজ মেয়েদের মাধ্যমে শুরু হলেও এটি তাদের জন্য নেগেটিভ হিসেবে কাজ করে, তাদের নেতৃত্বের ক্ষমতাকে খর্ব করে।
সেমেটিক ধর্ম যথা ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্ম প্রচলিত হওয়ার আগে গ্রিক, রোমান, হিন্দু সভ্যতার মিথলজি গুলো লক্ষ্য করলে নেতৃত্বে নারীদের ভূমিকার একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এই মিথলজিগুলোতে নানা ধরনের দেবদেবী রয়েছে। গ্রীক মিথলজিতে প্রধান দেবীরা হলেন হেরা, অ্যাথেনা, আফ্রোদিতি, আর্তেমিস প্রমুখ ; রোমান মিথলজিতে জুনো, মিনার্ভা, ভেনাস, ডায়ানা দেবীগণ ; এবং হিন্দু মিথলজিতে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, পার্বতী, কালী প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ পোর্টফোলিওধারী দেবীগণ।
দেবদেবীদের মধ্যে নানা ধরনের কর্মবন্টন রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের মন্ত্রণালয় যেমন যুদ্ধ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি বিভিন্ন পোর্টফলিওগুলো আলাদাভাবে বন্টন করা রয়েছে। খেয়াল করলে দেখা যায়, দেবীদের দায়িত্বপ্রাপ্ত পোর্টফোলিও গুলো অনেক ভারী, দেবতাদের চেয়ে অনেক সময় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো কাকতালীয় কোন বিষয় নয় । সে সময়ের নারীদের নেতৃত্ব ও গুরুত্ব পরিস্ফুটিত হয় এ কালচারাল চিহ্নগুলো দিয়ে । (মিথের উৎপত্তি ও ব্যাখ্যা নিয়ে আমার একটি লিখা আছে, কমেন্টসে দেয়া হলো, পড়লে ভালোভাবে রিলেট করতে পারবেন।) অন্য ধর্মগুলো বিশ্লেষণ করলেও নারী নেতৃত্বের গুরুত্ব উঠে আসে।
বিশাখা, আম্রপলি প্রমূখ বুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ নারী শিষ্যাগণ সংঘের বিভিন্ন অংশের নেতৃত্ব দেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় কার্যক্রমে ও ধর্ম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
কুইন অফ শেবা বা রাণী বিলকিস এর কথা কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি রাষ্ট্রপ্রধানের মতো নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছিলেন। মুহাম্মদ (সা:) এর সময়ে, তার স্ত্রীরা এবং অন্যান্য মহিলারা গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছিলেন। খাদিজা (র) সফলভাবে একটি বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন এবং প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ইসলাম গ্রহণ করেন। আয়েশা বিনতে আবু বকর ঊষ্ট্রীর যুদ্ধে ( জংগে জামাল) সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। হাদিসগ্রন্থ সমূহের মধ্যে হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২২১০ টি। যা সাহাবায়ে কেরামদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বর্ণিত হাদিস সমূহও শুধু তার একক সাক্ষ্যের ওপরে বিশুদ্ধতার সকল বিবেচনায় উত্তীর্ণ। মুহাম্মদ (সা:) উম্ম ওয়ারাকাকে পুরুষ ও নারীদের ওপর ইমাম হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। সর্বপ্রথম ইসলামের জন্য শহীদও হয়েছেন একজন নারী—সুমাইয়া (রা.)। নবীজির মৃত্যুর পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়।
এখনকার অনেক মুসলিম প্রধান দেশে নারীর নেতৃত্ব বিষয়ক অবস্থান একাদশ থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপে চার্চের রাজত্বকালে চার্চের যাজক কাম শাসকরা যে অবস্থান তৈরি করেছিলেন ওইটার একটা প্রোটো টাইপ চলছে। ইউরোপে যখন গির্জা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নেয়, তখন নারীদের অবস্থার উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়ে। রাজনীতি ও সামাজিক জীবনে গির্জার প্রভাব নারীদের অধিকার ও ভূমিকা হ্রাসের দিকে নিয়ে যায়।
তবে পৃথিবীতে যারা নারীর অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি ফেরি করে বেড়ায় তাদের আড়াইশো বছরের ইতিহাসে কত পাগল, বদমাইশ , যুদ্ধবাজ, রক্ত পিপাসু ক্ষমতায় এসেছে কিন্তু কোন নারীকে তারা সর্বোচ্চ পর্যায়ে আসার সুযোগ করে দেয়নি। এগুলো তাদের অনেক ভন্ডামীর একটা।
আধুনিক মানুষের ইতিহাসে হ্যাটশেপসুট, ক্লিওপেট্রা, সম্রাজ্ঞী হেলেনা, জোয়ান অফ আর্ক, ফার্স্ট এলিজাবেথ, , বেগম রোকেয়া , লক্ষ্মীবাঈ, প্রীতিলতা, মার্গারেট থ্যাচার, মাদার টেরেসা, ইন্দিরা গান্ধী, এঞ্জেলা মের্কেল ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে সকলের জন্য উদাহরণ হয়ে থাকবেন। সমসাময়িক আরো অনেকের কথা বলা যায়, তবে অযথাই বিতর্ক হবে ভেবে নামগুলো দিলাম না।
ইতিহাস বাদ দিলাম । ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। বেশ কিছু নারী সহপাঠী ও সহকর্মী , যাদের সাথে পড়েছি , চাকুরিতে ঢুকেছি, অথবা এক দুই বছর আগে-পরে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছি –গত ১০-১২ বছরে সুযোগ পেয়ে তারা নিজেদেরকে যেভাবে তৈরি করেছেন, অর্পিত দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন, নেতৃত্ব গুণ গড়ে তুলেছেন সেটি আসলে প্রশংসা করার মতো। তারা একেকজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে পাবলিক সার্ভিস ও প্রাইভেট সার্ভিসে মিড লেভেলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এরা প্রকৃতপক্ষে একই সাথে তিন-চারটা চাকরি করে।
পরিবার সামলিয়ে, বাচ্চাকাচ্চা বড় করে এবং নিজের কর্মক্ষেত্রে অনুকরণীয় ভূমিকা পালন করছেন তারা। শুরুতে কারো কারো অতিরিক্ত নরম-শরম স্বভাব , অন্তর্মুখী আচরণ ইত্যাদি দেখে মনে মনে ভেবেছি, এরা চাকরিতে নিশ্চয়ই বড় ধরনের ঝামেলা তৈরি করবে। নিজের এই ভুল ধারণার জন্য এখন লজ্জিত বোধ করি। একটা ভালো সুযোগ তাদের উজ্জ্বল ভূমিকা রাখার পেছনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
তবে নারীদের সফলতা সরল-রৈখিক না, সফল নারীদের হিংসুটেরা মৌমাছির ঝাকের মত আক্রমণ করে। যে কোন সমাজে সফল নারীর উজ্জ্বল অবস্থান, নেতৃত্ব, সুনাম ইত্যাদি হিংসা ও শত্রুতা ডেকে আনে। এদেরকে শীতল, নাক-উচা, উচ্চাভিলাষী, অরমনীয় ইত্যাদি ট্যাগ দেয়া হয়। পুরুষদের ভাল কিছু অনুকরণযোগ্য হিসেবে ভাবা হয়, মেয়েদের সফলতা দেখে ছেলে-মেয়ে উভয়ের মধ্যে ইনফিরিওটি প্রবলতর হয়। ফলে সফল নারীরা নির্বিচারে হিংসা ও শত্রুতার স্বীকার হয়, প্রাপ্য সম্মান পান না। মেয়েদেরকে যাদের ভালোবাসে তারাও হিংসে করতে পারে। ভালবাসা ও হিংসা মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ না। এত হিংসা নিউট্রালাইজ করতে মেয়েদের অতিরিক্ত শক্তি ক্ষয় করতে হয়।
সফলতার কারণ হিসেবে অনেক সময় মেয়েদের শারীরিক সৌন্দর্য, পারিবারিক প্রভাব প্রতিপত্তি ইত্যাদিকে ক্রেডিট দেয়া হয়। অথচ বাস্তবিকভাবে বিশ্লেষণ করলে এই বিষয়গুলো পুরুষদের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। যে দোষ গুলো জেন্ডার নিউট্রল, যে সমস্যাগুলো নারী-পুরুষ উভয় করতে পারে, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রে নারীদের জন্য অতিরিক্ত ভাবে হাইলাইট করা হয়।
নারীর শত্রু নারীরা, এটার সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক প্রমাণ নারীরা কৃষিকাজ আবিষ্কার করলেও, এটাই আসলে তাদের গুরুত্ব ও নেতৃত্ব জায়গা থেকে বের করে দেয়। সমসাময়িক কালেও এটি প্রাসঙ্গিক, অনেক ক্ষেত্রে এক নারীর সফলতার জন্য অন্য নারীগণ আরো বেশি হিংসা করেন। এটি নারীর নেতৃত্ব অর্জনে বাড়তি প্রেশার হিসেবে কাজ করে।
সফল নেতৃত্বের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এম্পাথি, কেয়ার এগুলো আল্লাহপাক নারীদের জন্মগতভাবে অনেক বেশি দিয়েছেন । মা হিসেবে, বোন হিসেবে্, স্ত্রী হিসেবে এগুলো তারা দৈনন্দিন চর্চা করে্ন। এগুলো তাদের শক্তির আধার। এগুলোর পাশাপাশি আমার দৃষ্টিতে আর দুটো জিনিস মাথায় রাখলে নেতৃত্বে তাদের ভূমিকা আরও শক্তিশালী হবে। পুরুষ বা অন্য কেউ হেল্প করবে না ধরে নিয়েই পরামর্শ গুলো বলা।
১। নারীদের পিরিয়ড, প্রেগন্যান্সি , ব্রেস্ট ফিডিং, মেনোপজ ইত্যাদি নানাবিধ্ ইস্যুর সাথে শারীরিক ও মানুষ মানসিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হয়। কখনো কখনো মন ও শরীর দুর্বল হয়, নানাবিধ কারণে চূড়ান্ত রকমের মুড-সুইং হতে পারে। শারীরিক বিভিন্ন হরমোনাল ফাংশন মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলে। নারীদের হরমোন ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের সাথে হ্যাপি হরমোন যেমন ডোপামিন, সেরেটোনিন, অক্সিটোসিন ইত্যাদির সম্পর্ক খুব জটিল। অনেক সময় ফোকাসড থাকা বেশ কঠিন হয়ে যায়, মেজাজ মর্জি ধরে রাখা ওই সময়টাতে অনেক কঠিন। কন্ট্রোল একদম লুজ হয়ে গেলে ভুল করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এই পরিবর্তনকে মেনে নিয়েই, ধারাবাহিক চর্চার মাধ্যমে নিজের উপর যতটা কন্ট্রোল নিয়ে আসা যায়, কর্মজীবনের এবং নেতৃত্বে জায়গায় আরো বেশি ইনফ্লুয়েন্স করা যাবে। কারণ ভুল করলে কেউ আর ভুলের কারণ অনুসন্ধান করতে যাবে না, ভুলকে সাধারণ ভুল হিসেবে ধরে নিয়ে মেয়েদের উপর দোষ চাপানো হয়।
২। উপরের আলোচনায ও ইতিহাসের পাতা বিশ্লেষণ করলে সফল নারী নেতৃত্বের অনেক গুণাবলী বের করে আনা যাবে। তবে সবার একটা জিনিস খুব কমন। এমপেথি, কেয়ারকে নারীদের গুণ হিসেবে অভিহিত করলেও পুরুষদের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সফল হতে গেলে এগুলো মাস্ট। সেভাবে নারীদের নেতৃত্বের জায়গায় সফল হতে গেলেও সমাজের তথাকথিত পুরুষালী বৈশিষ্ট্য যেমন স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা, এসার্টিভনেস ডেম-ক্যায়ার ভাব থাকা জরুরী। মেইন সাজেশন বাংলার চেয়ে ইংরেজিতে বেশি মাথায় থাকবে, সেটাই নিচে লিখে দিলাম।
Dear Ladies,
Don't be afraid to confidently assert yourselves with unwavering resolve, determination, and strength. Success will come to those who persevere. Pursue your endeavors with unwavering dedication, and success will undoubtedly follow.
ফটোগ্রাফি: আনিস শেখ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন